বাসস
  ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৪

শহিদ তাজুলের ছোট ছেলের কাঁধে এখন পরিবারের কঠিন ভার

॥ দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ ॥

কুমিল্লা, ৫ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : সুখের সংসার ছিল তাজুল ইসলামের। সংসারে সচ্ছলতা না থাকলেও শান্তি ছিল। ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া দিয়ে টেনেটুনে কোনরকমে চলত সংসার। কিন্তু এখন সে উপায়ও নেই । পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে শহিদ তাজুলের পরিবার বড়ো অসহায়।

স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ছিল তাজুল ইসলামের(৫৮) সংসার। এক সময় নিজেই ট্যাক্সিক্যাব চালাতেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারনে আর গাড়ী চালাতে পারতেন না। একমাত্র সম্বল পুরোনো ট্যাক্সিক্যাব। যা আরেকজনের সাথে পার্টনারে কিনেছিলেন ছয় লাখ টাকা দিয়ে। সেটি ভাড়া দিয়ে টেনেটুনে সংসারের খরচ মেটাতেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তাজুল ইসলাম পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। এখন অসহায় এ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাজুলের একমাত্র ছেলে রেদোয়ান আহমেদ সিয়ামের (১৫) ওপর। ছোট বয়সে তার কাঁধে এসে পড়েছে পরিবারের কঠিন ভার।

গত ১৮ জুলাই কোটা বিরোধীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকার আমির কমপ্লেক্সের সামনে গুলিবিব্ধ হয়ে নিহত হন তাজুল। পরদিন ১৯ জুলাই বুকের ভেতর গুলি রেখেই ময়নাতদন্ত ছাড়া তাজুলকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত মো. তাজুল ইসলাম বরুড়া উপজেলার উত্তর শীলমুড়ি ইউনিয়নের গামারোয়া গ্রামের মিয়াজী বাড়ির মৃত আইয়ুব আলীর ছেলে। তিনি পরিবার নিয়ে পূর্বাচল এলাকার কাঞ্চনব্রিজ সংলগ্ন উলুখোলা এলাকায় বাস করতেন।

তিনি তাঁর দুমেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস (২৫) ও মেঝ মেয়ে নুসরাত জাহানের (২২) বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে রেদোয়ান আহমেদ সিয়াম বেকার। কিন্তু তাকে এখন পরিবার সামলাতে হবে। তাই কাজ খুঁজতে হচ্ছে রেদোয়ানকে।

শহিদ তাজুলের স্ত্রী হোসনেআরা বেগম বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন আমার স্বামী। তিনি মারা যাওয়ায় আমাদের এখন দিশেহারা অবস্থা। আমার একমাত্র ছেলে বেকার। তার কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ভীষণ কষ্ট করেই দিন চালাতে হচ্ছে। এ জন্যে দরকার জরুরি সহায়তা। সরকার পাশে না দাঁড়ালে আমরা  কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবো?

তাজুলের একমাত্র ছেলে রেদোয়ান আহমেদ সিয়াম বলেন, সেই দিন বাবা আশুরার রোজা রেখেছিলেন। সারাদিন আজমপুর আমির কমপ্লেক্সের কাছে একটি রেন্ট-এ-কারের অফিসে ছিলেন। বিকেলে ইফতারি নিয়ে বাসায় ফিরবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি। হঠাৎ গুলি এসে বাবার বুকটা ঝাঁঝরা করে দেয়। সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাবা।

সিয়াম আরো বলেন, ঘটনার দিন ঢাকা শহরের গোলাগুলির খবরে বাবাকে আমরা রাস্তায় বের হতে নিষেধ করেছিলাম। বাবা দুপুরে জানান, তিনি উত্তরার একটি মসজিদের ভেতর আছেন। চালককেও গাড়ি রাস্তায় বের করতে দেননি। বিকেলে সংঘর্ষের সময় রাস্তায় উঁকি মারতেই গুলিবিদ্ধ হন। মোবাইলে খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে বাবার গুলিবিদ্ধ মরদেহ দেখতে পাই। বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা এখন কোন কূল-কিনারা পাচ্ছি না। পরিবারের দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না।

নিহত তাজুল ইসলামের  ভাই শামছুল হক বলেন, তাজুল এলাকায় খুব ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলো। সে ধার্মিক ছিলো। তার একটি মাত্র ট্যাক্সিক্যাব ছিল। ওই ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে সে পরিবার চালাত। ঘটনার দিন সে রোজা ছিল। সন্ধ্যায় ইফতার নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বুলেট সব শেষ করে দিয়েছে। ভাইটি শহিদ হওয়ার পর পরিবারটি খুবই অসহায় হয়ে পড়ে। গ্রামের বাড়িতে ভাঙ্গাচুরা একটি ঘর রয়েছে। কিন্তু তাতে থাকার মতো অবস্থা নেই।  আমরা চাই পরিবারটির সহযোগিতায় সরকার এগিয়ে আসুক।

শহিদের চাচা আব্দুল আলীম মিয়াজি বলেন, তাজুল ইসলাম খুবই সহজ সরল জীবন যাপন করতো। সে মারা যাওয়ায় পরিবারটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমরা তাজুল ইসলামের হত্যাকারীদের বিচার চাই। পাশাপাশি ওই পরিবারটির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চাই।

বরুড়া উপজেলা যুবদলের আহবায়ক ও সাবেক পৌর মেয়র জসিম উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বরুড়া উপজেলায় নিহত ও আহতদের পাশে আমরা ছিলাম এবং থাকবো।

কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা ও আমাদের সাবেক এমপি জাকারিয়া তাহের সমুন আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের কিছু সহযোহিতা করা হয়েছে। আমরা এ অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে সরকারসহ বরুড়ার সকল বিত্তবানদের প্রতি আহব্বান জানাই।

বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নু-এমং মারমা মং বাসসকে বলেন, তাজুল ইসলামের পরিবারটি খুবই অসহায়। বাড়িঘরের অবস্থাও ভাল না জেনেছি। আমরা এ উপজেলার শহিদ তাজুল ইসলামসহ বাকিদের তালিকা করে পাঠিয়েছি। পরবর্তী নির্দেশনা আসলে সে অনুযায়ী আমরা তাদের পাশে থাকবো।