শিরোনাম
সুনামগঞ্জ,৭ নভেম্বর,২০২৪ (বাসস) : ‘লেখাপড়া ছাইড়া দিলেও ছাত্র আন্দোলনে ছিলাম। দেশের প্রয়োজনে ভবিষ্যতেও যে কোন আন্দোলনে থাকবো’-কথাগুলো সুনামগঞ্জের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত কিশোর রহমত আলীর।
নিজ গ্রামের বড় ভাই রিপনকে কাছে থেকে পুলিশের গুলি করার দৃশ্যটি মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিলেন রহমত। এ সময়ে হেলমেট পরা পুলিশ সদস্যের লাঠির বাড়িতে গুরুতর আহত হন তিনি। কিন্তু আহত হয়েও এখনও মনোবল তার অটুট। দেশের যে কোন প্রয়োজনে আবারও রাজপথে নামার সাহস রাখেন দৃঢ়চেতা এই কিশোর।
বাউল শিল্পী ও অটোরিক্সা চালক জিয়াউর রহমানের পুত্র রহমত আলী (১৭)। তার মায়ের নাম পারভীন বেগম। ২০০৭ সালের ১০ এপ্রিল সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কুরবাননগর ইউনিয়নের মাইজবাড়ী পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাড়ীতে জন্ম তার।
সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মাহবুবুর রহমান স্বপনের অধীনে রহমতের চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এ চিকিৎসার খরচ চালাতে তার পরিবারকে ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে।
সেদিন ৪ঠা আগস্ট রবিবার বিকেল আড়াইটার ঘটনা। ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ জেলা সদরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকা সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একদিকে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কার্যত মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ প্রশাসন বিরোধী দলকে দমন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থনে এগিয়ে আসে। এ সময়ে ব্যাপক ইট পাটকেল নিক্ষেপ ও ভাংচুর চলে। পুলিশ প্রথমে টিয়ারগ্যাস সেল নিক্ষেপ করে এবং পরে ব্যাপক লাঠিচার্জ করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে যখন ব্যর্থ হয় তখনই শুরু করে বেপরোয়া গুলি বর্ষণ। শহরের আরপিননগর ও জামতলা আবাসিক এলাকার প্রতিটি বাসভবনে করা হয় পরিকল্পিত হামলা।
সাড়ে ৪ ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষে উভয় পক্ষের প্রায় অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়। কিন্তু সকলের মধ্যে গুরুতর আহত রহমত আলী খোকনের ইতিহাস একেবারেই ভিন্ন। রহমত আলী কোন রাজনৈতিক দলের নেতা কিংবা কর্মী নয়। সে পেশায় একজন ছাত্র। মা বাবার সংসারে এক বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান সে। তার একমাত্র বোন সুমি আক্তার লিজা (২৩) বিবাহিত। ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী (১১) শহরতলীর আলহেরা জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় হাফিজি ক্লাসে পড়ালেখা করছে। রহমত আলী সুনামগঞ্জ হাজী মকবুল পূরকায়স্থ উচ্চ বিদ্যালয়ের (এইচ.এম.পি উচ্চ বিদ্যালয়) দশম শ্রেণির ছাত্র।
রহমত আলী যাদের সাথে লেখাপড়া করে তাদের অনেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল। সহপাঠিদের আগ্রহ উৎসাহ উদ্দীপনায় ঐদিন সে পুরনো বাসস্ট্যান্ডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ কর্মসুচিতে যোগ দেয়। দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার প্রায় শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা বিএনপির অফিস ভাংচুর শেষে শহরের ট্রাফিক পয়েন্ট এর দিকে যখন চলে যায় ঠিক তখনই সর্বস্ব শক্তি নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করে আন্দোলনকারীরা। কিন্তু মাঝখানে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুলিশ প্রশাসন। শত শত রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে আরপিননগর ও জামতলার দিকে আন্দোলনকারীদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করে পুলিশ। কিন্তু শহরের মূল রাস্তা ছেড়ে পুলিশ দল যখন দুই মহল্লায় প্রবেশ করে ব্যাপক লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস সেল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করতে থাকে তখনই নিরুপায় হয়ে দ্বিগবিদিক ছুটতে শুরু করে আন্দোলনরত নেতাকর্মীরা। এ সময় আরপিননগরের সাইফুল মিয়ার বাসার দেয়ালের পেছনে নিজেকে আড়াল করে আত্মরক্ষা করে রহমত আলী। এর আগে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জের ফলে ভেঙ্গে যায় রহমত আলীর ডান হাত।
সুনামগঞ্জের স্থানীয় নেতারা বলেন, রাজপথে পুলিশের হাতে আহত রহমত আলী আমাদের গর্ব ও অহংকার। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনের স্থানীয় একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে তার প্রতি আমাদের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। তারা রহমত আলীর অসহায় পরিবারের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক মোঃ উসমান গনী ও ইমনোদ্দোজা আহমদ প্রমুখ শিক্ষার্থীরা জানান, পুলিশের লাঠিচার্জে হাত ভেঙ্গে যায় রহমত আলীর। প্রাণের ভয়ে হাসপাতালে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে পারেনি সে।
রহমত আলীর বাবা বাউল জিয়াউর রহমান বলেন, পুলিশের লাঠিচার্জে আমার ছেলের হাতটি ভেঙ্গে গেছে। এখন সে অসুস্থ, খুব কষ্টে আছি আমরা। কিছুদিন পাড়া-প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় চিকিৎসা করিয়েছি। এখনও চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এর খরচ চালানো আমাদের জন্যে দুঃসাধ্য হয়ে পেড়েছে।
রহমত আলীর মা পারভীন বেগম বলেন, আমার ছেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে গিয়ে আহত হয়েছে। তার হাতটি ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু সে এতটাই ভীত ছিল যে,তার বাবার ভয়ে ঘটনার কথা কাউকে জানায়নি। তাছাড়া ঐ সময় শহরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করায় সে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ারও সাহস করেনি। আমরা যখন দেখলাম ভাঙ্গা হাতটি লুকিয়ে রেখে সে নীরবে বেদনায় কাতরাচ্ছে তখনই আমার ভাই ঘটনার ৮ দিন পর ১১ আগস্ট তাকে নিয়ে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়েছে। আমার ছেলেসহ অসংখ্য নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর যারা হামলা করেছে আমি তাদের বিচার চাই।
আহত রহমত আলী বলেন, আমি নবম শ্রেণি পাশ করার পর দশম শ্রেণিতে ভর্তি হই এবং ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাসে যাই। জুন মাস থেকে আর্থিক সমস্যার কারণে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ঝরে পড়া ছাত্র হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ডাকে ঘটনার সময় আমি প্রথমে এইচএমপি উচ্চ বিদ্যালয়ে যাই। সেখান থেকে সকল ছাত্র মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বেলা দেড়টায় মিছিল সহকারে পুরনো বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওয়ানা হই। গিয়ে দেখি পুরনো বাসস্ট্যান্ড কার্যত একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। গুলিবিদ্ধ রিপন ভাইসহ প্রায় ৫০ জন লোক আহত হয়েছে পুলিশের গুলি,টিয়ারগ্যাস সেল ও লাঠিচার্জে। অন্যান্যদের মত পুলিশের লাঠিচার্জে আমিও আহত হই এবং আমার ডানহাত ভেঙ্গে যায়। ঐ সময় আমি একটি বাসার দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে পড়ি। তানাহলে হয়তো পুলিশ আমাকেও গুলি করে মেরে ফেলতো। ঘটনার পরে বাড়িতে ফিরে যাই। একটা ফার্মেসী থেকে ব্যথার জন্য ঔষধ নেই। অথচ মা-বাবার ভয়ে হাতভাঙ্গার কথা কাউকে বলিনি। পরদিন টেলিভিশনের সংবাদে জানতে পারি আমাদের ছাত্র আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার আফম আনোয়ার হোসেন খান পিপিএম বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিষয়ে আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি। এই কমিটির কার্যক্রম চলছে। আহত রহমত আলীর চিকিৎসার বিষয়েও আমরা সহায়তা করব।