বাসস
  ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৯
আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮

সবসময়ই বাবার কথা বলে আর কাঁদে শিশু রাতুল ও সিদ্দিক

প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ

ঢাকা, ২০ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন আলী হোসেন। ফলে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে তার আর পড়ালেখা করা হয়নি। বাবার যেটুকু সম্পত্তি ছিল তাও পদ্মার ভাঙ্গনে শেষ হয়েছে অনেক আগেই। আলী হোসেন রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ‘নিউ সুপার মার্কেট দক্ষিণ’ কাঁচাবাজারের দ্বিতীয় তলায় ‘সাদা কালো ফ্যাশন হাউজ’ নামের এক দোকানে কর্মচারি হিসেবে কাজ করতেন।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ শে জুলাই রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন আলী হোসেন(৪০)। গুলিটি বুকের ডান পাশে এসে লাগে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাত ১১ টার দিকে মারা যান তিনি। সাত ভাইবোনের মধ্যে আলী হোসেন ছিলেন সবার ছোট। বাবা মো. ইদ্রিস মারা গেছেন বহুবছর আগে। তখন আলী ছিলেন একেবারেই ছোট। মা রংমালা (৬০) জীবিত থাকলেও অনেকটাই অসুস্থ। ছোট সন্তানের মৃত্যুর পর একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছেন।

দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখেই কাটছিল আলীর জীবন। বড় ছেলে সিয়াম হোসেন রাতুল (১৩) এবং ছোট ছেলে সিদ্দিক হোসেন (৬)। আলী হোসেন ২০০৯ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার রত্না আক্তারকে (৪০) বিয়ে করেন।

আলী হোসেনের এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না পরিবার। দুই শিশু সন্তানকে এখন কে দেখবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, এমন দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে আলীর স্ত্রী ও বৃদ্ধ মায়ের।

আলী হোসেনের স্ত্রী রত্না আক্তার বলেন, ‘এত ছোট বয়সে ছেলে দুইটা বাবাকে হারিয়েছে। আমিও কোন চাকুরি করি না। ছেলে দুইটার ভবিষ্যত কি হবে? ছেলেদের কিভাবে পড়া লেখা শেখাবো? পড়ালেখা করাতে গেলে তো অনেক খরচ। ছোট ছেলেটার চোখের সমস্যা, ওকে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হয়। আমি সেই খরচের টাকা পাবো কোথায়? ওর আব্বার অল্প আয়ে আমাদের সংসার চলতো। কষ্ট করে কোন রকম ভাবে দিন পার করতাম। এখন ছেলে দুইটার ভবিষ্যত কি হবে? ওদের নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেছি।’

তিনি বলেন, ঘটনার দিন ১৯ শে জুলাই। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ওর আব্বু বাসা থেকে বের হয় দোকানে যাওয়ার জন্য। দোকানে পৌঁছে একবার আমাকে ফোন করে। পরে দুপুরে একবার কথা হয়। সর্বশেষ আমার সাথে বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে কথা হয়। আমি তাকে বলি চারদিকে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে, সাবধানে বাসায় এসো। সে বলে সমস্যা নেই। আমরা সবাই দোকনে আছি, কোন সমস্যা হবে না। ভিডিও কলে দোকানের সবাইকে দেখান। দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার সময়ে নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ির সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় আলী।

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকার চিনি বটতলার বাসায় সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা জানান শহিদ আলী হোসেনের স্ত্রী রত্না আক্তার।

স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে ভাড়া বাসায়। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন আলী। তার মৃত্যুতে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না স্ত্রী রত্না আক্তারের। আলীর মৃত্যুতে পুরো পরিবারটিতে নেমে এসেছে অন্ধকার।

আলী হোসেন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার জাজিরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু নদী ভাঙ্গনের পর থেকে পরিবারের সবাই রাজধানীর কামরাঙ্গীচর এলাকার চিনিবাড়ি এলাকায় বাস করতেন।  

আলী হোসেনের বড়ভাই আলী আকবর বলেন, ‘১৯ শে জুলাই নিউমার্কেট এলাকায় বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় আমার ভাই। সন্ধ্যায় আমরা খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। একটা গুলি আমার ভাইয়ের বুকের ডান পাশে লাগে। সেদিন নিউমার্কেট এলাকায় অনেক গোলাগুলি হয়। আমাদের ভাইবোনের মধ্যে আলী ছিল সবার ছোট। আমাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। বাবা অনেক আগে মারা যান। মায়ের বয়স হয়েছে। ছোট সন্তানকে হারিয়ে একদম ভেঙে পড়েছেন।

তিনি বলেন, আমরা সব ভাইবোন কামরাঙ্গীরচরে পাশাপাশি থাকি। ওর সন্তানরা বাবাকে হারিয়ে অসহায় জীবন-যাপন করছে। বড় ছেলেটি মাদ্রাসায় পড়তো। ওর বাবা মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে নিয়ে এসেছি। সন্তানরা সব সময় বাবার কথা বলতে থাকে, বাবার জন্য কাঁদে।

আলী আকবর আরও বলেন, বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যান। তখন আলী হোসেন অনেক ছোট ছিল, কিছুই বুঝতো না। বাবা মারা যাওয়ার পরে আমিই ভাইটিকে মানুষ করি। আমাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না। বাবা একটি পাউডার কারখানায় কাজ করতেন। ভাই যেদিন মারা যায় সেদিন সকাল নয়টার সময় আমার সঙ্গে কথা হয়। সে তখন কাজে বের হয়। আমি ওকে বলি, ভাই যাই করো না কেন চারদিকের অবস্থা বেশি ভালো না, সোজা দোকানে গিয়ে আবার সোজা বাসায় চলে এসো। আমিও মার্কেটে চাকরি করি। ও চলে আসার এক-দেড় ঘণ্টা পর আমিও মার্কেটে যাই। আবার দোকান বন্ধ করে দুপুরের দিকে বাসায় চলে আসি। মার্কেটে থাকতে ঘটনার আগেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। নিউমার্কেটের ১ নম্বর গেট থেকে বের হতে চেয়েছিল আলী। ওর সঙ্গে আরেকটি লোকও মারা যায় গুলিতে।

আলী আকবর বলেন, ভাই হারানোর যন্ত্রণা কাউকে বোঝানোর মতো না। আমাদের সবার ছোট হওয়ায় অনেক আদরের ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে মানুষ হয়েছে। সেজন্য ওর প্রতি অনেক মায়া আমার।

তিনি বলেন, আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তাকে হারিয়ে স্ত্রী-সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়েছে। সন্তানদের নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তা করতে থাকে। কীভাবে মানুষ করবে, কীভাবে গড়বে তাদের ভবিষ্যৎ। ওদের বাবা যে টাকা আয় করতো তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলতো। অল্প আয় থাকলেও সন্তানদের জন্যতো ও  ছায়া হয়েই ছিল। সব বাবা-মায়েরই তো চিন্তা থাকে সন্তানদের নিয়ে। এখন আলীর মৃত্যুতে হতাশ হয়ে পড়েছে তার স্ত্রী। সন্তানদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা করছে।

আলী হোসেনের স্ত্রী বলেন, লাশ নিয়ে অনেক ঝামেলা ছিল। মৃত্যুর তিনদিন পর অনেক জায়গা দৌড়িয়ে, অনেক ভোগান্তি পেরিয়ে আমার স্বামীর লাশ বুঝে পাই। পরে ২২ জুলাই আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেই তার পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল।

আলী হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।

এ সময়ে তিনি অন্তর্বতী সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, ‘আমি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাবো, আমার স্বামী যে শহিদ হয়েছে তার মর্যাদা চাই। ছেলে দুটারে নিয়ে যাতে কোন রকম খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারি সরকার যেন তার ব্যবস্থা করে দেন।’

‘সাদা কালো ফ্যাশন হাউজ’-এর মালিক (আলী হোসেন যে দোকানে কাজ করতেন) সিরাজ জানান, আলী খুব ভালো ছেলে ছিল। ওর মৃত্যুটা মেনে নিতে কষ্ট হয়।