শিরোনাম
প্রতিবেদন: আজাদ রুহুল আমিন
বাগেরহাট, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, (বাসস) : প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকায় বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকায় যার ছিল সরব উপস্থিতি, রাজপথে থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ছিলেনআকণ্ঠ প্রতিবাদী তিনি পান ব্যবসায়ী জসিম ফকির।গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহিদ হন তিনি। তবে লাশ মেলে দু’দিন পরে।
গত বিশ বছর ধরে গাজীপুরের কালিয়াকৈর সফিপুর আমিরুল সুপার শপের পাশে স্ত্রী শারমিন খানম (২৭) ও একমাত্র কন্যা তোহফা ইসলাম তানহা (৭) কে নিয়ে বসবাস করতেন জসিম ফকির (৩৬)। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন যখন অনিবার্য ঠিক সেইদিন গণঅভ্যুত্থানে যোগ দিতে কাউকে না জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি। দিনটি ছিল ৫ আগস্ট। এরপর আর দুইদিন তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরিবার থেকে অনেক খোঁজাখুঁজি চলে। কিন্তু তারা হতাশ হন।
শেষ পর্যন্ত গত ৭ আগস্ট খুব সকালে এক নারী আনসার সদস্য জসিমের মৃত্যু সংবাদের কথা নিশ্চিত করেন। জসিমের স্ত্রী শারমিন ওইদিন বেলা ১২ টার দিকে লাশের সন্ধান পান গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।এরপর ৮ আগস্ট খুব ভোরে শহিদ জসিম ফকিরের লাশ এম্বুলেন্স যোগে নিয়ে আসা হয় তার নিজ গ্রাম বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কলাতলা ইউনিয়নের চর চিংগুড়ী গ্রামে। এ গ্রামেই তার জন্ম। এ গ্রামইএখন তার শেষ ঠিকানা।
লাশ গ্রামে পৌঁছালে হাজারো মানুষের ভীড়ে সৃষ্টি হয় শোকের আবহ। পুরো গ্রামজুড়ে চলে শোকের মাতম।চর চিংগুড়ি সরকারি প্রাইমারি স্কুল মাঠে জানাজা শেষে সকাল ৯ টায় স্থানীয় মাদ্রাসার পাশে কবরস্থানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
শহিদ জসিম ফকিরের বাবা মোঃ হায়াত আলি (৮০) ও মাতা সেলিনা বেগম (৬৭)। তারা জানান, জসিমের পিঠে ছিল বুলেট বিদ্ধের দাগ, নাক কান রক্তাক্ত,মুখমণ্ডল থেঁতলানো।
তবে আন্দোলনে যোগ দেয়ার পর জসিম ঠিক কখন কিভাবে মারা গিয়েছিলেন তার প্রত্যক্ষ বিবরণ তার পরিবার পায়নি।
জসিম ফকিরের রয়েছে আরও তিন ভাই। বড়ভাই মুরাদ হোসেন অনার্স ফাইনালের আগেই মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। যাকে এলাকায় এক নামে ‘পাগলা মুরাদ’ বললে সবাই চেনে। জসিমের পরের ভাই রিয়াদ হোসেন ও ছোট ভাই আবির হোসেন রিফাত। তারা দুজনেই এস এস সি পাস করেছে।
জসিমের একমাত্র কন্যা তোহফা ইসলাম তানহা গাজীপুর শাহীন ক্যাডেট স্কুলেক্লাস ওয়ানে পড়ছে।স্ত্রী শারমিনের বাবা হেমায়েত হোসেন মোল্লা (৮০)ও মা আয়না মতি (৬০)। জসিম ফকিরের বাবাও একজন ভ্রাম্যমাণ পান বিক্রেতা। গ্রামের হাটে বাজারে ঘুরে ঘুরে পান বিক্রি করেন। সহায় সম্বল তেমন নেই।
নিজের অর্জিত টাকা দিয়ে ছোট ভাইসহ একটি জমি কিনেন। কিন্তু ছোট ভাই মারা গেলে তার সন্তানরা এখন জমি ভোগ করতেও দিতে চান না।এখন পর্যন্ত তারা কোন প্রকার আর্থিক সাহায্য পাননি। খেয়ে না খেয়ে খুবই কষ্টে চলে পরিবারটির।
স্ত্রী শারমিন খানম মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন। বাসস প্রতিনিধির সাথে শারমিনের একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ হয়। তিনি তাদের বর্তমান করুণ অবস্থার কথা জানান। তিনি বলেন,‘আর্থিক অনুদান পাওয়ার অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনও কোন সাহায্য সহযোগিতা মেলেনি।বাবার বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ি থেকে সামান্য যা পাচ্ছি তাদিয়েই কোনমতে চলছি। কিন্তু মেয়ের লেখাপড়ার খরচ তো ভবিষ্যতে বাড়বে। তখন কিভাবে কি করবো ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছি না।’
জসিম ফকিরের বাবা মোঃ হায়াত আলি বলেন,আমরাখুবই অসহায়। আমাদের বলতে গেলে ভিটেমাটি সহায় সম্পত্তি কিছুই নেই। দিন চলে কোন রকমে। এর মধ্যে জসিমের স্ত্রী ও মেয়ের খরচ কে দেবে? কিভাবে চলবে তাদের?
এদিকে মা সেলিনা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমি আমার পাগল ছেলে মুরাদকে নিয়ে কোনভাবে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। আমাদের কোন সহায় সম্বল নেই। সরকার ও রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দাবি দেশের জন্য অকাতরে আমার সন্তান জীবন বিসর্জন দিয়েছে।সরকার যদি আমাদের বিপদে এগিয়ে আসে তাহলে বৃদ্ধ বয়সে ডাল আলুভর্তা খেয়ে কোনরকমে জীবন যাপন করতে পারতাম।আমরা সেদিকে তাকিয়ে আছি।
এদিকে শহিদ জসিম ফকিরের ভাই রিয়াদ হোসেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানায় এ বিষয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
বাগেরহাটের নবাগত পুলিশ সুপার তৌহিদুল আরিফ জসিম ফকিরের কবর জেয়ারত ও পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন।
তিনি পরিবারটিকে সবধরনের সহায়তারও আশ্বাস দিয়েছেন।