শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : তাসফিয়া তাবাসসুম তুবা তার বাবার ঠিক করে দেওয়া নাম বহন করেই বড় হবে। কিন্তু নিজ চোখে আর বাবাকে দেখা হলো না তার। তুবা বড় হয়ে যখন জিজ্ঞেস করবে, ‘বাবা কোথায়?’ তখন আমি কি উত্তর দেবো? আমার সন্তান তার বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে। কোনদিন সে তার বাবাকে দেখতে পাবে না।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে সম্প্রতি আলাপকালে এমন আহাজারি করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহিদ রবিউল ইসলাম ফরাজীর স্ত্রী তানিয়া আক্তার।
তিনি বলেন, ‘গত ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়িতে ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী রবিউল পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এর এক মাস ২০ দিন পর তুবার জন্ম হয়। নবজাতকের যে নাম রেখেছি তা ঠিক করে গিয়েছিলেন রবিউলই। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! তুবা তার বাবার ঠিক করে দেওয়া নাম বহন করে বড় হবে, কিন্তু নিজ চোখে তাকে (বাবাকে) আর দেখতে পাবে না কোনদিন।’
তানিয়া আক্তার বলেন, ‘তুবা বড় হয়ে যখন জিজ্ঞেস করবে, ‘বাবা কোথায়?’ তখন কি উত্তর দেব? আমার সন্তানকে তার বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’
একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কীভাবে তুবাকে লালন-পালন করবেন তা নিয়ে চরম শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তানিয়া। তিনি এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা কামনা করেন।
নবজাতক তাসফিয়া তাবাসসুম তুবার জন্মের মাত্র ২০ দিন আগে বাবা রবিউল ইসলাম (২৭) গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ১৯ জুলাই রাজধানীর ঢাকার যাত্রাবাড়িতে পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেইনিহত হন। এ ঘটনার আগে রবিউল তার সন্তানের নাম ঠিক করে গিয়েছিলেন।
রবিউলের গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের পাদ্রিশিবপুর ইউনিয়নের শাকবুনিয়া গ্রামে। তিনি ১৯৯৭ সালের ১৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। রবিউলের স্ত্রীর বয়স ২৫ বছর। তিনি এইচএসসি পাশ করেছেন। তার বাবা আব্দুল লতিফ ফারাজি (৬৫) এবং মাতা দেলোয়ারা বেগম (৫৫)। তারা থাকেন বাকেরগঞ্জে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রবিউল ছিলেন সবার ছোট। তবে সব ভাই বোনেরা আলাদা আলাদা ভাবে কামরাঙ্গীচরে বরগ্রাম বড়মসজিদ এলাকায় বসবাস করেন। পারিবারিক ভাবে রবিউল ও তানিয়ার বিয়ে হয় ২০২২ সালে। রবিউলের দোকান ছিল নবাবপুর সিটি মাকের্টে।
রবিউলের বড় দুলাভাই সাইফুল ইসলাম বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই সে সক্রিয় ছিল। ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে আন্দোলনে যেত। আন্দোলন চলাকালে সে ১৯ জুলাই শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।পরে ২০ জুলাই শনিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল থেকে তার লাশ বুঝে পাই। সেখান থেকে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে ২২ তারিখ সকাল হয়ে যায়। পরে সকাল ৭ টায় বাকেরগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, শুরু থেকেই সে প্রতিদিন আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতো। প্রতিদিনের মত ওই দিনও নামাজ শেষে খাওয়া দাওয়া করে আন্দোলনে যায় রবিউল। পরে বিকেল ৪ টার দিকে ওর সাথে থাকা শাকিল নামের একজন জানান, যাত্রাবাড়ি থানার সামনে রবিউলের বুকে গুলি লেগেছে। পরে আমরা সেখানে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে রবিউলের কোন খবর পাচ্ছিলাম না। তখন আশে পাশের মানুষ জানায় যারা এখানে গুলি খেয়েছে, তাদের সবাইকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। তখন আমরা সবাই ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে অনেক খোঁজাখুজির পরে দেখি একপাশে ট্রলির উপরে পড়ে আছে রবিউলের নিথর দেহ। চিকিৎসকরা জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।
রবিউলের বড় বোন নূপুর আক্তার বলেন, ‘ও (রবিউল) আমাদের সবার ছোট ভাই ছিল। অনেক আদরের ছিল। ওকে ঢাকায় নিয়ে এসে প্রথমে আমার বাসায় রেখেছিলাম। বিয়ের আগে আমার বাসায় থেকেই নবাবপুরে ব্যবসা করতো। বিয়ের পরে ওদিকে আলাদা বাসা নেয়। ভাইটার একটা মেয়ে হয়েছে। দেখলে অনেক মায়া লাগে। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই রবিউলের মুখটা ভেসে ওঠে।
রবিউলের স্ত্রী তানিয়া কান্না করতে করতে বলেন, আমাদের সুখের সংসারে এমন পরিস্থিতি কেন হলো? আমার মেয়েটার ভবিষ্যত ও নিরাপত্তা কে দেবে? সংসার কিভাবে চলবে? কিভাবে ওকে পড়া লেখা শেখাবো? মেয়েদের ভবিষ্যত কি হবে? এমন প্রশ্ন করে তিনি আবার কাঁদতে শুরু করেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি বলেন, মেয়েটার নিরাপদ ভবিষ্যত চাই। ওকে সঠিক ভাবে পড়া লেখা শেখাতে চাই। কিন্তু আমি তো কোন চাকুরি করিনা। আমি কি করবো? তাই সরকারের প্রতি আহবান, মেয়ের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে যাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
সন্তান রবিউল ইসলামের এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না বাবা আব্দুল লতিফ। ছেলের হত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছোট বেলা থেকে ছেলেটা অনেক কষ্ট করেছে। মানুষের দোকানে কাজ করেছে। পড়ালেখা করতে পারে নাই। অনেক কষ্টে ধারদেনা করে এখন সে নিজে একটা দোকান দিয়েছিল। কিন্তু আমার নির্দোষ ছেলেটারে মাইরা ফেলল। আমার বুক খালি কইরা, আমার নাতিনরে এতিম বানাইয়া দিল। নাতিনটা ওর বাবার মুখটাও দেখতে পারলো না। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’