বাসস
  ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫

দিনমজুর পিতার সহযোগি ছিলেন কিশোর তোফাজ্জল, এখন পরনির্ভর

প্রতিবেদন : মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী

সুনামগঞ্জ, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : তোফাজ্জল হোসেন। বয়স ১৪ বছর। পেশায় রেস্টুরেন্ট বয়। রোববার, ৪ আগস্ট। সরকার পতনের একদফা দাবিতে সারা দেশের মতো সুনামগঞ্জ শহরও উত্তাল। সকাল থেকেই দিনটি ছিল থমথমে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা দখলে নেয়। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সাধারণ জনতা। আর এদের সাথে যোগ দেয় কিশোর তোফাজ্জল।

এদিকে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ট্রাফিক পয়েন্ট এলাকায় দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়।

বেলা সাড়ে ১১ টারদিকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের একদফা দাবিতে ছাত্রজনতা শুরু করে বিক্ষোভ মিছিল। মিছিলটি শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে যাওয়ার পথে কামারখাল এলাকায় পৌঁছালে শুরু হয় পুলিশের এ্যাকশন। পুলিশ নির্বিচারে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ছুঁড়তে থাকে। টিয়ারশেল আর রাবার বুলেটের শব্দে প্রকম্পিত হয় পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকা।

পুলিশের বেপরোয়া টিয়ারশেল আর রাবার বুলেটের মুখে টিকতে না পেরে ছাত্রজনতা পিছু হঠতে থাকে। ছাত্রজনতা আর পুলিশ, ফ্যাসিস্টদের দোসর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে কয়েক দফা চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এক পর্যায়ে শহরের পুরাতন বাস্টস্ট্যান্ড এলাকায় বিশ্রামে থাকা রেস্টুরেন্ট বয় তোফাজ্জল দেখে তার মতো অনেক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়েছে। কালক্ষেপণ না করে তোফাজ্জলও যোগ দেয় মিছিলে। এ সময় আরও হিংস্র হয়ে ওঠে পুলিশ। পুলিশের টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটের তীব্রতায় টিকতে না পেরে পিছু হটে জেলা সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের কালেক্টরেট এলাকায় অবস্থান নেয় ছাত্রজনতার একটি অংশ। পুলিশের টিয়ারশেলের ধোঁয়া আর ঝাঁঝে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে জেলা কালেক্টরেট এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়।

ছাত্রজনতার আরেকটি অংশ শহরের আরপিন নগর গলির ভেতর ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। এতেও রক্ষা হয়নি ছাত্রজনতার সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়া তোফাজ্জল হোসেনের। আরপিন নগর কবরস্থান এলাকায় পৌঁছালে পুলিশের গুলি তার বাম উরুতে বিদ্ধ হয়। সেখানে কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটি সাফেলা গ্রামে সরেজমিন তোফাজ্জলের বাড়ি গিয়ে জানা গেছে এসব তথ্য।

সে দিনের ভয়াবহ ও করুণ চিত্রের বর্ণনা দিয়ে তোফাজ্জল বাসসকে জানান, ওইদিন ছাত্রজনতার সাথে অন্দোলনে যোগদেন তোফাজ্জল। পুলিশের গুলি ও টিয়ারশেলের মুখে টিকতে না পেরে অন্যান্য আন্দোলনকারিদের সাথে তিনিও আরপিন গলির ভেতর ঢুকে পড়েন। এসময় তিনি আরপিন নগর কবরস্থান এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ তাকে গুলি করে। গুলি তার বাম উরুতে বিদ্ধ হয়।

তোফাজ্জল আরও জানান, উরুতে গুলি লাগার পর তিনি মাটিতে গড়াগড়ি করলেও হাসপাতালে নেয়ার মতো কেউ এগিয়ে আসেনি পুলিশের ভয়ে। মাটিতে গড়াগড়ির এক পর্যায়ে রৌজ গার্ডেনের বাবুর্চি লিলু মিয়া তাকে উদ্ধার করে সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালে কয়েক দফা চিকিৎসা চলে তোফাজ্জলের। প্রথম দফা তার উরু থেকে দুই থেকে তিনটি গুলি বের করেন চিকিৎসকরা। এর পর বাড়িতে চলে আসেন তোফাজ্জল। কয়েকদিন পর উরুতে ব্যথা হলে আবারও সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এসময় তার উরু থেকে আরও কয়েকটি গুলি বের করেন চিকিৎসক। এর পর আরেক দফা উরুতে ব্যথা শুরু হলে আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন তোফাজ্জল।

তৃতীয় দফা সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন।

তোফাজ্জল জানান, সিলেট ওসমানী মেডিকেলে যাওয়ার পর তার উরু থেকে আরও তিনটি গুলি বের করেন চিকিৎসকরা। এরপর ডান উরু থেকে মাংস নিয়ে বাম উরুতে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়।

তোফাজ্জল আরও জানান, তিনি উপজেলার ইয়াকুব উল্লাহ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। পরিবারে অর্থকষ্ট লাঘবে তিনি রেস্টুরেন্টে চাকুরি নেন। চাকুরিতে যোগ না দিলে তোফাজ্জল এবার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকতেন।

সেদিন আহত রেস্টুরেন্ট বয় তোফাজ্জলকে উদ্ধারের ভয়ংঙ্কর বর্ণনা দেন রৌজ গার্ডেনের বাবুর্চি লিলু মিয়া।  

লিলু মিয়া বাসসকে জানান, তিনি হঠাৎ শুনতে পান তার রেস্টুরেন্টের বয় তোফাজ্জল পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে। এ খবর শুনে তিনি বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তাকে তিনি খুঁজে পান শহরের আরপিন কবরস্থানের পাশের সড়কে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তোফাজ্জল তখন চিৎকার করছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাকে উদ্ধার করে রেস্টুরেন্টের অন্যান্য বয়ের সহযোগিতায় সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালে পাঠান।

তোফাজ্জলের মা মোছা. লুৎফা বেগম বাসসকে জানান, তার স্বামী একজন দিনমজুর। সংসার চলেনা। তোফাজ্জল পরিবারের বড় ছেলে তাই তাকে গত মে মাসে পড়া লেখা বাদ রেখে সুনামগঞ্জ রৌজ গার্ডেন রেস্টুরেন্টে চাকুরিতে পাঠান।

তোফাজ্জলের বাবা মো. আকবর আলী জানান, দুই মেয়ে, দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার পরিবার। দিনমজুরি করে সংসার চলে না। তাই বড় ছেলে তোফাজ্জলকে সুনামগঞ্জ রৌজ গার্ডেন নামের রেস্টুরেন্টে চাকুরিতে দিয়েছেন। ছোট ছেলে রায়হান আহমদ গ্রামের (সাফেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।  বড় মেয়ে আকলিমা আক্তার সুমাইয়া(১৮) ও ছোট মেয়ে মাহমুদা বেগম(১৬)কে জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার আমবাড়ি পঞ্চগ্রাম মহিলা মাদরাসায় (আবাসিক) পড়তে দিয়েছেন। বড় মেয়ে এবার দশম শ্রেণিতে ও ছোট মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।

তিনি বলেন, তোফাজ্জল এতোদিন সংসারকে সহায়তা করেছে। সকলের ভরণ পোষণে আমার সাথে সাথে আর্থিক দায়িত্ব পালন করেছে। এখন সেই তোফাজ্জলই পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

আকবর আলী আরও জানান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মনাজ্জির হোসেনের সহযোগিতায় চিকিৎসা খরচ চালানো হয়েছে।
এছাড়া স্থানীয়ভাবেও আরো কিছু আর্থিক সহযোগিতা তারা পেয়েছেন। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম।

তিনি তার ছেলেটি যেন সুস্থ হয়ে ওঠে সে জন্যে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।

এদিকে সুনামগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মনাজ্জির হোসেন  বাসসকে জানান, জেলা বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ সংগঠনগুলো চিকিৎসার জন্য তোফাজ্জলকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে।