বাসস
  ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:০৪

‘স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আমি চোখে অন্ধকার দেখছি’-শহিদ জসিমের স্ত্রী

প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন 

ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস): ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ দেশে ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটেছে। গত৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এই অভ্যুত্থানে যোগ দিয়ে বহু মানুষ যেমনি প্রাণ হারিয়েছেন তেমনি অনেকেই হয়েছেন আহত। নিঃস্ব হয়ে পড়েছে বহু পরিবার। এমনই একজন রিকশা চালক মোঃ জসিম। তাকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তার স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া। 

ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থানে রূপনেয়। আর এই সময়ে নগরীর যাত্রাবাড়ির দনিয়া এলাকার গুয়ালবাড়ি মোড়ের স্থায়ী বাসিন্দা জসিম (৩৫) গত  ২১ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

রাজিয়া জানান, তার স্বামী ওইদিন মাগরিবের নামাজ পড়তে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গুয়ালবাড়ি মোড়ের একটি মসজিদে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে রাস্তার পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে পড়ায় তিনি মসজিদে  না ঢুকে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন। বাড়ি ফেরার পথেই একটি গুলি তার পিঠে লাগে।

একটি ছবিতে দেখা যায়, বুলেটটি তার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক ভেদ করে বেরিয়ে আসে।

সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটের দিকে কেউ তাকে ফোন করে জানায় তার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। 

রাজিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘খবরটি শুনে, আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম এবং সাথে সাথে আমি বাসার নিচে নেমে দেখি আমার স্বামীকে আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। যারা আমার স্বামীকে বাসার সামনে নিয়ে এসেছিলো তাদের সহায়তায় আমার স্বামীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

তিনি বলেন, ‘সারা দেশে অস্থির পরিস্থিতি থাকায় পোস্ট মর্টেম না করেই আমরা হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে আসি এবং সেই রাতেই তাকে দনিয়া কবরস্থানে দাফন করি।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি আরো বলেন, শনির আখড়া বাসস্টপ থেকে প্রায় ৪০০ মিটার ভেতরে আমেনা ভিলার সামনে ওই সময় ‘হেলমেট বাহিনী’ ও ইউনিফর্ম ও সাদা পোশাকের পুলিশসহ প্রায় ৪০ জন লোক নির্বিচারে গুলি ছুঁড়ছিল।

স্থানীয় লোকজন জানায়, ওই দিন গুয়ালবাড়ি মোড়ে ঘটনাস্থলেই জসিমসহ অন্তত ছয়জন নিহত হন এবং খুনিরা কয়েকজনের লাশ নিয়ে যায়।

রাজিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘খুনিরা আমার স্বামীর লাশ গুম করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু লোকজন তার লাশ নিতে দেয়নি। তারা জসিমকে চিনতে পেরে খুনিদের প্রতি ইটপাটকেল মেরে তার লাশ রেখে দেয়।’

খুনিদের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ‘ওরা আমার ছেলেকে এতিম করেছে। যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই। সরকারের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, খুনিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনুন।’

রাজিয়া তার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তার কষ্টের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। কিন্তু, তার শাহাদাতের পর থেকে আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’

একমাত্র ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজিয়া আরো বলেন, ‘আমি দু’বার স্ট্রোক করেছি, আমি জানি না আমি কতদিন বাঁচব। আমি চলে গেলে আমার ছেলেটার কি হবে! সে তো একা হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার।  আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আমি চোখে অন্ধকার দেখছি।’

শোকাহত রাজিয়া আরো বলেন, কয়েক বছর আগে আমার বাবা ও শ্বশুর দু’জনই ইন্তেকাল করেছেন। একারণে আমাদের  দেখারও কেউ নেই। আমার একমাত্র ছেলে জীবন আহমেদ (২১) এখন আমার অবলম্বন। সে একটি কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে কাজ করে মাসে ১০ হাজার  টাকা আয় করে। তাই দিয়ে কোনোমতে আমাদের সংসার চলে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজিয়া সুলতানা তার একমাত্র ছেলে নিয়ে গুয়ালবাড়ি মোড় এলাকায় দুই কক্ষের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন। যার মাসিক ভাড়া ৭ হাজার টাকা। তিনি বলেন, বাসা ভাড়া মিটিয়ে ছেলের সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালানো খুবই কঠিন। 

‘কোভিড-১৯’ এর আগে জীবন এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আমরা তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি। আমি সরকারের কাছে আমার ছেলের জন্য একটি উপযুক্ত চাকরির আবেদন জানাই, যাতে সে ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে।’

স্থানীয়  লোকজনের সাথে আলাপকালে তারা জানান, জসিম খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যদের সাহায্য করতেন।