বাসস
  ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৩৯

জুলাই অভ্যুত্থান : দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে লড়ছেন জাবি অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী

সাভার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : জুলাই-আগস্ট ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. লুৎফুল এলাহী উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডের রুতনিন চক্ষু হাসপাতালে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেখানে আগামী সপ্তাহে তার ডান চোখে দ্বিতীয় অপারেশন করা হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ও সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী তাদের অন্যতম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলনে অধ্যাপক লুৎফুল সব সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অংশ নিতেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি জুলাইয়ের গণআন্দোলনের সময় ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নেন।

গত ১৫ জুলাই বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় জাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে ছুটে আসেন।

পরে রাতে ছাত্রলীগের হামলার বিচার চেয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনে যান। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আবারও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়।

এ সময় অধ্যাপক লুৎফল আবারও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে ছুটে আসেন। সেখানে ছাত্রলীগের হামলায় পরে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন তিনি।

প্রায় ৭০টি গুলি তার শরীরে প্রবেশ করে। দুটি গুলি তার ডান চোখে আঘাত করে। এতে তার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইওএইচ) কয়েকদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরও তিনি সুস্থ না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি থাইল্যান্ডে যান।

তিনি থাইল্যান্ডের তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু তার শরীরে বিদ্ধ হওয়া সব গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। তার মাথা ও মুখের অংশে এখনও ৬৫টি গুলি লেগে আছে। একটি গুলি তার ডান চোখের রেটিনায় প্রবেশ করে। তা সরানো যায়নি।

আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক লুৎফল এলাহী বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলনে আমি সব সময় অংশগ্রহণ করেছি। আমি নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জুলাইয়ের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ১৫ জুলাই বিকেলে যখন লীগ কর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় তখন আমি, বর্তমান প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিনসহ কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে এগিয়ে যাই।

তিনি আরো বলেন, ‘পরে রাতে ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আবার হামলা চালায়। খবর পেয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের বাঁচাতে সেখানে যাই। ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর আমরা বিভিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পুলিশ বাহিনী সেখানে উপস্থিত হলেও তারা হামলা ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’ 

অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী  বলেন, ‘হামলার সময় খবরটি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে আসে। তখন পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। আমি শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। আমি সেখানে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার পরিচয় দেয়ার পরও তারা আমাকে গুলি করে। আমার শরীরে অনেক গুলি লেগেছিল এবং আমি তখনই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ 

তিনি আরো বলেন, দেশে চিকিৎসা নেওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য আমি থাইল্যান্ডে যাই। সেখানে অপারেশনের পরও তার ডান চোখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেনি। আমি এখনও শরীরে বিদ্ধ গুলির যন্ত্রণা সহ্য করছি।
গুলি ডান চোখের রেটিনায় প্রবেশ করায় তা চোখ থেকে বের করা যায়নি। তাই দ্বিতীয় অপারেশনের জন্য তিনি থাইল্যান্ডে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

অধ্যাপক এলাহী বলেন, ‘আমি হয়তো কখনোই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাব না। আমরা তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতার নিন্দা জানাই। যারা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে তাদের বিচার চাই। আশা করি দেশের মানুষ জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও স্বপ্নকে রক্ষা করবে।’ 

তিনি বলেন, ‘যে স্বপ্ন ও চেতনার জন্য মানুষ রক্ত ঝরিয়েছে এবং তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে আমরা সেই স্বপ্ন ও চেতনা রক্ষায় আমাদের সব প্রচেষ্টা উৎসর্গ করছি।’

জাবি ইউনিটের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মেহেরাব শিফাত বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক আমাদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী স্যার সবার সামনে ছিলেন। ১৫ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের ও পুলিশের হামলায় পুলিশের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। তিনি না থাকলে অনেক ছাত্র মারা যেত।’

শিফাত বলেন, ‘পরবর্তীতে, তিনি তার চিকিৎসা চলাকালেও বিভিন্নভাবে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সাহস দিয়েছিলেন। আমরা এই মহান শিক্ষকের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্মান জানানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী স্যারকে সম্মান জানাতে চাই।’ 

শিফাত জানান, আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহনের জন্য তারা উদ্যোগ নিয়েছেন। অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। বৈষম্য বিরোধী প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে আমরা তাকে আর্থিকভাবে সম্মানও দেবো।

জাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ বলেন, যে কোনো আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনন্য। স্বৈরাচারী শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় সোচ্চার ছিলাম। আমরা শিক্ষক-ছাত্র ঐক্য প্লাটফর্মের ব্যানারে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। সেসব আন্দোলনে অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী ছিলেন আমাদের অন্যতম সঙ্গী।

তিনি আরো বলেন, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ও আমরা ফ্যাসিবাদী সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। সে সময় অধ্যাপক এলাহী সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ছাত্রদের ওপর নৃশংস হামলার সময় তিনি আহত হয়েছিলেন। ১৫ জুলাই মধ্যরাতে তার ত্যাগ ও অবদান আমরা সবসময় স্মরণ করব।’ 

অধ্যাপক সোহেল আহমেদ  বলেন, ‘আমরা বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে অধ্যাপক লুৎফুল এলাহীর চিকিৎসা ব্যয় বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি তার একটি চোখ হারিয়েছেন। তবে, আমরা তার সুস্থতার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। পাশাপাশি, আমরা জুলাইয়ের বিদ্রোহে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল শিক্ষার্থী আহত হয়েছে তাদের চিকিৎসার খরচ বহন করব।’