শিরোনাম
প্রতিবেদন : মাসুদ রানা
জয়পুরহাট, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : মেহেদি ছিলেন দরিদ্র অটোচালক। জেলার নতুনহাট এলাকায় বসবাস করতেন। সংসারে অভাব ছিল, কিন্তু সুখের ঘাটতি ছিল না। নিজে অটো চালিয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতেন।
মেহেদী হাসান (২৯) মাত্র এক শতক জমিতে ঘর করে স্ত্রী সৃষ্টি, ছেলে আসিফ ও মেয়ে মেহেরন নেছাকে নিয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু সে সুখ আর রইল না।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ দ্বিতীয় বার স্বাধীন হবার দিন সন্ধায় তিনি বাসা থেকে অটো নিয়ে শহরে যান বিজয় উৎসবে শামিল হতে। কিন্তু উৎসব পরিণত হয়েছে শোকে। সেদিন শহরে আসার পর থানা ঘেরাও হয়েছে শুনে মেহেদি থানা দেখতে যান। সন্ধ্যার কিছু পরে মেহেদী গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর পিঠের ডান দিক দিয়ে একটি গুলি লেগে তা বুকের ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। সেখান থেকে ছাত্র-জনতা তাঁকে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জয়পুরহাট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এখবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে মেহেদী’র স্ত্রী জেসমিন আকতার সৃষ্টি (২৪) তা জানতে পারে। পরে পরিবারের লোকজন শহিদ মেহেদীকে রাতে বাসায় নিয়ে আসে। পরদিন তাঁকে নতুনহাটস্থ সরদারপাড়া পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বর্তমানে মেহেদীর স্ত্রী সৃষ্টি ১০ বছরের মেয়ে মেহেরন নেছা ও ৫ বছরের ছেলে আসিফকে নিয়ে আছেন ভীষণ শংকায়। দুই ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত কিহবে? এ প্রশ্ন বুকে নিয়ে সে দিন পার করছে।
জয়পুরহাট জেলা শহরের পৌর এলাকার দরিদ্র নাইটগার্ড ৫নং ওয়ার্ডের নতুনহাট শেখপাড়ার মৃত আলতাফ হোসেন শেখ ও ফাতেমা বেগমের সাত ছেলে-মেয়ের মধ্যে মেহেদী ছিলেনছয় নম্বর সন্তান। চার ভাই ও তিন বোনসকলেই দরিদ্র। ভাইবোনেরা যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
মেহেদী বিয়ের পর নতুনহাট এলাকার এক শতাংশ জমিতে একটি ঘর বানিয়ে সেখানেই বসবাস করছিলেন। মেয়েকে পড়াশুনার জন্য স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় দিয়েছেন। সেখানে মেয়ে মেহরেন নেছা ২য় শ্রেণীতে পড়ছে। আর ছেলে আসিফ বাসায় থাকে, এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। স্ত্রী জেসমিন আকতার সৃষ্টি স্থানীয় একটি ট্রাউজার তৈরীর কারখানায় কাজ করতেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনের উর্পাজনে সংসার মোটামুটি ভালই চলছিল তাদের। কিন্তু হঠাৎ করে মেহেদীর মৃত্যুতে স্ত্রী সৃষ্টি এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এখন সে ঐ ট্রাউজার তৈরীর কারখানায়ও আর যায়না। বাসায় থাকে সারাটা দিন। দুই বাচ্চাকে নিয়ে মহাচিন্তায় থাকে সৃষ্টি। তাদের লেখাপড়া হবে কিভাবে? সংসার চলবে কিভাবে? এসব প্রশ্ন বুকে নিয়েই সে এখন বেঁচে আছে।
এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার জন্য মেহেদী’র বাড়িতে গেলে দেখা মেলে শহিদ মেহেদী’র স্ত্রী জেসমিন আকতার সৃষ্টির। সে সংসারের কাজ করছে অন্য দিনের মতই। মেয়ে মাদ্রাসায় থাকে। ছেলে আসিফ মায়ের সাথে দুষ্টুমি করছে। তার কাছে জানতে চাইলে সে কান্নাজড়িত কন্ঠে বাসস’কে জানান এসব কথা।
শহিদ মেহেদীর শ্বশুর ইলেকট্রিক মিস্ত্রি জামাল উদ্দিন (৪২) এর সাথে কথা বললে তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বাসস’কে বলেন, আমার জামাই আর নেই, এটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। আমার জামাই মেহেদী দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়ে শহিদ হয়েছে। আমরা চাই আর যেন কাউকে দেশের জন্য প্রাণ দিতে না হয়। এখন আমার মেয়েটা কি নিয়ে বাঁচবে? আমার মেয়ে যেন সুখে-শান্তিতে বাচ্চাদের নিয়ে বাঁচতে পারে এজন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি। সরকার যেন সহায়তা দেয় অসহায় পরিবাটিকে।
এদিকে সৃষ্টির সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ তারিখে সরকার পরিবর্তনের পর হতে তাদের কাছে অনেকেই এসেছেন। জেলা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাকে ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের পক্ষ হতে ১ লাখ টাকা, ইসলামী একটি সংস্থা হতে ১ লাখ টাকা, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে নতুনহাট এর ইজারাদার প্রতি শনিবার সৃষ্টিকে হাটের দিন ১ হাজার টাকা করে দেন। জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ তাদের সাথে দেখা করে আগামীতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক আফরোজা আক্তার বাসস’কে বলেন, আমি শহিদ মেহেদীর বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর সাথে দেখা করে পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়েছি। তাকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামান্য কিছু উপহার প্রদান করেছি। তার নাম সরকারিভাবে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামীতে সরকারি যে কোন সাহায্য সহযোগিতা পেলে তাঁর স্ত্রীকে দেওয়া হবে। এছাড়া তাঁর স্ত্রীর জন্য জেলা প্রশাসকের দরজা সবসময় খোলা আছে। যেকোন সময় যেকোন সমস্যা হলে আমাকে জানালে তা সমাধান করে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করবো।’