শিরোনাম
প্রতিবেদন : সেলিম আউয়াল ও শুয়াইবুল ইসলাম
সিলেট, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : নির্জন টিলায় শুয়ে আছেন সানি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন সানি আহমদ। টিলাটি এতো নির্জন, দিনের বেলায়ই ভয় হয়। আমরা সানির বাবা কয়সর আহমদের সাথে সেই গোরস্থানে পৌঁছি। আমাদের সাথে ছিলেন সানির ছোটভাই সামি আহমদ।
সামি কোরআন হিফজ করছেন, চার পারা মুখস্থ করেছেন। আমরা জেয়ারতের জন্যে যেখানে দাঁড়ালাম, সেখান থেকে কবর অনেক ঢালুতে, অভ্যাস না থাকলে কবরের পাশে যেতে চাইলে দুর্ঘটনার আশংকা আছে।
সানিদের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে। আমুড়া ইউনিয়নের শিলঘাট কুমারপাড়া গ্রামে। উপজেলা সদর থেকে যেতে হয় পাহাড়-টিলা পেরিয়ে। ভাইবোনের মধ্যে সানি দ্বিতীয়। ওর বড়ো বোন রিমার বিয়ে হয়ে গেছে। সানির থেকে বয়সে ছোট বোন ইমরানা বেগম রুফি, রুলি আক্তার রুহি, জুলি আক্তার জুঁই এবং সব ছোট ভাই সামি। সানির খুব শখ ছিলো পড়ালেখা করবে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। এরপর তার হৃদরোগ। কাজ করতে তো কষ্ট হয়, মাঝে-মধ্যে কথা বলতেও কষ্ট হয়। এজন্যে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে সানি কাজে নেমেছে।
সংসারের অভাব ঘুচানোর জন্যে বছর কয়েক ধরে সানি রাজমিস্ত্রির যোগালি হিসেবে কাজ করছিলো।
প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস হলেও সেখানে সানিদের নিজস্ব বসত ভিটেও নেই। তারা একটি বাড়িতে ভাড়া থাকে। সানির স্বপ্ন ছিলো কাজ করে করে তিনি একটুকরো বসতভিটে কিনবেন। সে ভিটায় থাকার ঘর বানাবেন। কিন্তু সানি পৌঁছাতে পারেননি তার স্বপ্নের কাছাকাছি। তার আগেই নিষ্ঠুর বুলেট কেড়ে নিলো তার প্রাণ।
কথা বলতে শুরু করেছিলেন সানির বাবা কয়সর আহমদ। বললেন, ছেলের লাশ দেখার পর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আমাদের সাথে আরো দুয়েকটি কথা বলার পরই কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেন তিনি। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
কয়সর আহমদের কাছ থেকে কথা কেড়ে নেন তার ছোট ভাই রাজু আহমদ, তিনি সানির ছোটচাচা। সানি তার সন্তানের চেয়েও প্রিয়। সেই শৈশব থেকেই সানি তার চাচার সাথে ঘুমাতেন। ঘটনার দিন ৪ আগস্টও সানি চাচার সাথে একই খাটে ঘুমিয়েছিলেন।
ভোরে চাচা রাজু আহমদ ক্ষেতের কাজে চলে যান। পরে সানিও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু সেই সানি আর জীবিত ফিরে আসেননি, এসেছে তার লাশ।
সানির চাচা রাজু আহমদ ক্ষেতে কাজ করছিলেন। গ্রামের মসজিদের মাইক থেকে তখন কিসব ঘোষণা আসছিলো, তেমন খেয়াল করেননি। বাড়িতে ফিরে আসছেন, তখন এক পড়শীর সাথে দেখা, বললেন, তোমার বাড়ির খবর জানোনি। একথা সেকথার পর শুনলেন হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুঁড়ে তার ভাতিজা সানিকে হত্যা করা হয়েছে।
পরে অবশ্য জেনেছেন হেলিকপটার থেকে নয়, আন্দোলনের সময় সানি মিছিলে অংশ নিয়েছিলো। সেই মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে সানি শহিদ হন। মিছিলটি হয়েছিলো গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন রাস্তায়।
রাজু আহমদ পরে ঘটনাস্থল দেখতে গিয়েছিলেন। এলাকার মানুষ বলেছেন, সানি এলাকার মানুষের সাথে মিছিলে ছিলেন। সানি গুলিবিদ্ধ হবার পর রাস্তার পাশের একটি বাড়ির কচু গাছের ঝোপে পড়ে যান। পরে তাকে গোলাপগঞ্জ উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে নেয়া হয়েছিলো। ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাজু আহমদের কাছে একটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে, তিনি দেখেছেন সানি আন্দোলনকারী মানুষের সাথে ছুটে যাচ্ছে।
ভূমিহীন পিতার জন্যে সানি ছোট্ট একটি ভিটাতে ঘর বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। সানি আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু সানির পিতা কয়সর আহমদ সানি হত্যার বিচার চান।