বাসস
  ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫২
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৩

আহত সৈকতের চিকিৎসার ব্যয় আর বহন করতে পারছে না পরিবার

প্রতিবেদন: মোহাম্মদ আবু বক্কর

চট্টগ্রাম, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস): সৈকত দাশ পেশায় একটি কসমেটিকস কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। হাটহাজারী ফতেয়াবাদ আদর্শ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও অর্থাভাবে আর বেশিদূর এগুতে পারেননি। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় সংসার চালানোর দায়িত্বটাও এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। 

ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত সৈকত (৩১) এক সন্তানের জনক। স্ত্রী দীপা দে (২৫) ও দেড় বছরের ছেলে সৌরনীল দাশ তীর্থ ছাড়াও পরিবারে রয়েছে দাদী,বাবা-মা ও ছোট ভাই। বাবা রতন দাশ (৬০) পেশায় একজন গার্মেন্টস শ্রমিক এবং মা শিল্পী দাশ (৫০) গৃহিণী। একমাত্র ছোট ভাই শৈবাল দাশ (২৭)। কিছুদিন চাকুির করলেও আপাতত বেকার। 

সৈকতের জন্ম ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুর ইউনিয়নে। তাঁর বাবা রতন দাশ জীবিকার তাগিদে ২৬ বছর আগেগ্রাম ছেড়ে পরিবার নিয়ে হাটহাজারীতে চলে আসেন। বর্তমানে সৈকত তাঁর পরিবার সহ হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডি ইউনিয়নের চৌধুরীহাট দাতারাম সড়কে স্বপন বাবু'র বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকেন। স্বল্প বেতনে চাকুরি করে সৈকত যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে কোনভাবে সংসার চলতো। উপার্জনক্ষম ছেলে বিছানায় পড়ে থাকায় চরম অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছে তাঁর পরিবার।

সৈকত বলেন, জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে আমি এরপ্রতিটি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি। আমাদের হাটহাজারী এলাকায় যেখানেই বৈষম্যবিরোধী মিছিল-মিটিং হতো আমি বন্ধুদের সাথে ছুটে যেতাম। মিছিল-মিটিং এর ছবি প্রতিনিয়ত ফেসবুকে শেয়ার করতাম। বিশেষ করে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের যৌক্তিক আন্দোলনের পক্ষে এবং পতিত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দিতাম। ফলে আমি আওয়ামী যুবলীগ-ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হই। একপর্যায়ে তারা আমার গতিবিধি অনুসরণ করতে থাকে।

সৈকত আরো বলেন, গত ৪ আগষ্ট জরুরি প্রয়োজনে লোকাল সিএনজি যোগে হাটহাজারী কাটিরহাট থেকে ফটিকছড়ির নাজিরহাট যাচ্ছিলাম। নাজিরহাট নতুন রাস্তার মোড় এলাকায় পৌঁছাতে সিএনজি থেকে নামার আগেই সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা আওয়ামী যুবলীগ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আমার পথরোধ করে। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে প্রথমে আমার পকেটে থাকা মোবাইল ও মানিব্যাগ কেড়ে নেয়। তারপর আমাকে হকিষ্টিক, লোহার রড ও কাঠের টুকরো দিয়ে বেদমভাবে পেটাতে থাকে। সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে আমার ডান পায়ে মারাত্মকভাবে জখম করে। এতে আমার ডান পায়ের হাঁটুর নীচের হাড় ভেঙ্গে দুই টুকরো হয়ে যায়। পেটানোর একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে তারা আমাকে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। খবর পেয়ে আমার বন্ধুরা ছুটে এসে গুরুতর আহত অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করে প্রথমেহাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়। ভর্তির ১২ দিন পর ডাক্তাররা অস্ত্রোপচার করে আমার ডান পায়ে স্ক্রু লাগান। ২৫ দিন চিকিৎসা শেষে বাড়িতে আসি। এরপর আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসা করি। বর্তমানে ক্রাচে ভর দিয়ে কোনভাবে হাটাচলা করলেও এখনো সুস্থ হতে পারিনি। অধিকাংশ সময় বিছানায় শুয়ে থাকি। ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিদিন ঔষধ ও পায়ের থেরাপি চলছে।

আন্দোলনে যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না। বর্তমানে ছাত্র না হলেও একসময় আমিও ছাত্র ছিলাম। তাই কোটা সংস্কার নিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনটা আমার কাছে যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছিল। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী দুর্বৃত্তদের কাপুরুষোচিত হামলা আমাকে ব্যথিত করেছিল। আমি মনে করি, মেধার সাথে কোন আপোস হয়না। মেধাই হবে যোগ্যতার মাপকাঠি। দেশের নাগরিক হিসেবে সকলের সমান অধিকার ও সুযোগ থাকা উচিত। কোটার কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়। তাই আমি মেধাবীদের পক্ষে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। এই অভ্যুত্থানের অংশীদার হতে পেরে আমি গর্বিত।’

সরকারি-বেসরকারিভাবে কোন সহয়তা পেয়েছেন কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,আমি যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিলাম শুধুমাত্র অপারেশনটা বিনামূল্যে করা হয়। বাকি ঔষধ, পরীক্ষা সহ যাবতীয় খরচ নিজেরা বহন করেছি। হাসপাতালে জেলা প্রশাসন থেকে দশ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। সরকারি-বেসরকারিভাবে আর কোন সহযোগিতা পাইনি। 

তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পরবর্তীতে চেকাপে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভালোভাবে কথাও বলে নি। এরপর নিজ খরচে অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েছি। তাঁরা ঔষধ ও থেরাপি দিয়েছেন। চিকিৎসা বাবদ ইতোমধ্যে তিন লক্ষ টাকা টাকা খরচ হয়ে গেছে। ধারদেনা করে চিকিৎসার খরচ যোগাতে হচ্ছে। সারাদিন ঘরে পড়ে থাকলেও খোঁজ খবর নেয় না কেউ।

সৈকত এর মা শিল্পী দাশ বলেন, আমার নিরীহ ছেলেটার কি দোষ ছিল? তাঁকে কেন এভাবে পিটিয়ে পাটা ভেঙ্গে দিল? আমার সুস্থ সবল ছেলেটা তিনমাস ধরে অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে। চলাফেরা করতে পারছেনা। ডাক্তার বলেছে পায়ে আবারও অপারেশন করাতে হবে। ছেলের উপার্জন দিয়েই আমাদের সংসার চলতো। এখন কিভাবে সংসার চলবে? কিভাবে ছেলের চিকিৎসা চলবে? আমার বৃদ্ধা শাশুড়ি হার্টের রোগী। আমার স্বামী যা রোজগার করেন তা আমার শাশুড়ির চিকিৎসার পিছনে ব্যয় হয়। ছেলের ডাক্তার, ঔষধ, থেরাপি খরচ মেটাতে গিয়ে আমরা আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে গেছি। পাঁচ মাসের ঘর ভাড়া বাকি। ইতোমধ্যে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে সরকার যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায় আমরা ছেলেকে সুস্থ করতে পারবো না।

সরকারের কাছে কিছু চাওয়ার আছে কি না জিজ্ঞেসকরলে তিনি বলেন,আমার নিরপরাধ ছেলেটাকে অন্যায়ভাবে পিটিয়ে পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আমি সরকারের কাছে দোষীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাই। আমার ছেলেটার সুচিকিৎসার জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। সরকার যদি একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তাঁর একটি কর্মসংস্থান হবে। আমাদের পরিবারটা ভালোভাবে চলতে পারবে।

কথা হয় সৈকতের বাবা রতন দাশের সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার দুই ছেলে। আর্থিক অভাব অনটনের কারণে তাদের পড়ালেখা করাতে পারিনি। বড় ছেলেটা একটা কোম্পানিতে কাজ করতো। তাঁর উপার্জনের ওপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিলো। পায়ের আঘাতের কারণে এখন সে ঘরবন্দী। কোথাও যেতে পারেনা। তার পায়ের আবারও অপারেশন করাতে হবে যার খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। সরকার যদি তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে তাহলে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। ছেলেকে একটি সরকারি চাকুরি দেওয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবি এম মশিউজ্জামান বাসস প্রতিনিধিকে বলেন, ‘সৈকতের বিষয়ে আমি অবগত। সরকারিভাবে কোন সহযোগিতা পেলে অবশ্যই তাঁকে পৌঁছে দেয়া হবে। বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও তাঁর পরিবারের পাশে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’