বাসস
  ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১০

‘আব্বা, আরজু ও আয়শারে দেইখা রাইখো’-ছোট্ট মেয়ের মুখে চুমু খেয়ে শেষ কথা বলে গেলেন শহিদ নয়ন

প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ

ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : আব্বা আমার গুলি লাগছে, আমি তো মনে হয় আর বাঁচবো না। তুমি আরজু ও আয়শারে দেইখা রাইখো। তুমি ওদের নিজের কাছে রাইখো। তুমি ছাড়া ওদের আর কেউ নাই।

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর রসুলপুরের মেম্বার গলি এলাকার ভাড়া বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা জানান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদ মো. নয়নের বাবা নুরুল ইসলাম (৬১)।

গত ৫ আগস্ট সকাল ৮ টার দিকে রাজধানীর নবাবগঞ্জ বড়মসজিদের ঢালে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন নয়ন (২৬)।  

কান্নাজড়িত কন্ঠে সন্তানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল সোয়া ৮ টার দিকে আমার ফোনে নয়নের ফোন থেকে ফোন আসে। ওপাশ থেকে বলা হয়, এই ফোনের মালিক আপনার কে? আমি বলি সে আমার বড় ছেলে। তখন ওদিক থেকে জবাব আসে, নবাবগঞ্জ বড় মসজিদের ঢালে সে গুলি খেয়ে পড়ে আছে। তখন আমরা সেখানে গিয়ে রিকশায় করে নয়নকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। যাওয়ার সময় নয়ন আমাকে বলে, ‘আব্বা আমি তো বাঁচবো না। আমাকে পুলিশ অনেকগুলো গুলি করেছে। আরজু ও আয়শারে তুমি দেইখা রাইখো। ওদের তুমি তোমার কাছে রাইখো। এই বলে সে মেয়ে আয়শার কপালে একটা চুমু খায়। এইটা ছিল আমার ছেলেটার শেষ কথা। এর পর নয়ন আরকোন কথা বলে নাই।’

নয়ন ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। তার স্ত্রী আরজু বেগম (২০)। মেয়ে আয়শা মনি। বয়স ৪ বছর। নয়ন নিউমার্কেট এলাকার গাউছিয়া মার্কেটে লেবারের কাজ করতো।

গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মুলাই পত্তন গ্রামে।  নয়নের বাবা নুরুল ইসলাম কখনো সেলাইয়ের কাজ করেন, আবার কখনো চালান রিকশা। মা মমতাজ বেগম (৫৯) গৃহিণী। নয়নের দুটি ভাই রয়েছে। মেজ ভাই হাসনাইন (২৪) ও ছোট ভাই মহসিন (২৩)। দুই ভাইও সেলাইয়ের কাজের ফাঁকে রিকশা চালান, লেবারের কাজও করেন।

নয়নের মেয়ে আয়শা মনি বলে, ‘আমার বাবাকে পুলিশ গুলি করেছে। বাবা বিদেশ চলে গেছে, পরে আসবে বলেছে। জানো আঙ্কেল, গুলি লাগার পরে আমি আর আম্মু যখন হাসপাতালে যাই, তখন আব্বু আমাকে একটা চুমু খেয়েছিল। তখন, আয়শা তার গাল দেখিয়ে বলে, ‘আব্বু এই গালে চুমু দিয়েছিল।’

এদিকে শহিদ হওয়ার পরে তার স্ত্রী আরজু বেগমকে ছোট ছেলে মহসিনের সাথে বিয়ে দিয়েছেন নয়নের বাবা নুরুল ইসলাম।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নয়ন যেহেতু আমাকে বলে গেছে, আরজু ও আয়শারে তোমার কাছে রাইখো। তাই আমি আমার ছোট ছেলে মহসিনের সাথে আরজুর বিয়ে দিয়েছি।

নাতিনটার মুখের দিকে তাকিয়ে এই কাজ করেছি। আমার তিনটা ছেলে। কোন মেয়ে নাই, তাই ওকে মেয়ে মনে করে ছোট ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছি।’

এ বিষয়ে নয়নের ভাই মহসিন বলেন, ‘পরিবারের সবাই আমাকে বিয়ের বিষয়ে বলেছে। আমি রাজি হয়েছি। কয়েক সপ্তাহ আগে বিয়ে  করেছি।’

নয়ন গত ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু মারা গেছেন৮ আগস্ট বিকেল ৫ টার দিকে। গত ৯ আগস্ট সকাল নয়টার দিকে জানাজা শেষে ভোলার বোরহান উদ্দিনের হাফিজ ইব্রাহিম মিয়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় তো আশে পাশে তেমন কেউ ছিলেন না। এক চায়ের দোকানদার জানায়, পুলিশ নয়নকে পেছন থেকে গুলি করেছে। এতে নয়নের বুকে, ঘাড়ে ও পিঠের চার জায়গায় চারটা গুলি লাগে। সাথে সাথে নয়ন রাস্তায় পড়ে যায়।’

তিনি জানান, সেদিন সকালে নামাজ পড়ে কাজের জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিল নয়ন। সকাল আটটার দিকে তারশরীরে গুলি লাগে।

তিনি বলেন, সকাল সাড়ে আটটার দিকে নয়নের ফোন থেকে আমার কাছে ফোন আসে। ফোন রিসিভ করি, তখন আমাকে বলে, এই ফোন যার সে আপনার কে হয়? আমি কি হয়েছে জানতে চাইলে, সে বলে নবাবগঞ্জ ঢালে তার গুলি লাগছে। তারপর সে কি বলছে আমি আর শুনতে পারিনি। পরে আমরা সবাইদৌড়ে সেখানে গিয়ে নয়নকে রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি কোন ডাক্তার নাই, নার্স নাই। হাসপাতালে শুধু রোগী আর রোগী। সে সময় নয়নকে ভর্তি না করে সারাদিন হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়। ফলে ওর শরীরের সব রক্ত বের হয়ে যায়। আগে থেকেই যদি চিকিৎসা শুরু করা যাইতো তাহলে ছেলেটা আমার বাঁচতো।’

নুরুল ইসলাম বলেন, অনেক অনুরোধ করার পর রাত ১২ টার পরে নয়নকে ভর্তি করানো হয়। তখন আর তার জ্ঞান ছিল না। পরের দিন নয়নের অপারেশন করে গুলি বের করা হয়। আমরা ৬ ব্যাগ রক্ত দেই নয়নকে। ৮ তারিখ দুপুরের দিকে ওর অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। তখন চিকিৎসকরা বলেন, নয়নের জন্য আইসিইউ লাগবে, কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে কোন আইসিইউ বেড খালি  নাই। তখন আমরা সাড়ে তিনটার দিকে নয়নকে ধানমন্ডির ম্যাক্স হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং ওখানে ভর্তি করি। কিন্তু চিকিৎসা শুরু করার আগেই বিকেল ৫ টার দিকে নয়নের মৃত্যু হয়।

সরেজমিনে কামরাঙ্গীচরের রসুলবাগের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, দ্বিতীয় তলায় একটি বাসায় ভাড়া থাকে নয়নের পরিবারের সবাই।  ছোট তিনটা রুম, তেমন কোন আলো বাতাস প্রবেশের পথ নেই। দিনের বেলায় বাসায় ঢুকতে হয় মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে। স্যাতস্যাতে একটা পরিবেশ। বাসার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় কী নিদারুণ কষ্টে সংসার চলে নয়নের পরিবারের।

সরকারি সহযোগিতা কি পেয়েছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে ক্ষোভ প্রকাশ করে নয়নের বাবা বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী শুধু এক লাখ টাকা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমি কোন সহযোগিতা পাইনি। শুধুবলে দেওয়া হবে, কিন্তু কবে দেওয়া হবে, আর কবে পাওয়া যাবে তা কেউ বলে না। আমি গরীব মানুষ। ধারদেনা করে চিকিৎসা করতে হয়েছে। গত ৮ তারিখ যখন ওকে ম্যাক্স হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে যাই তখন ৪২ হাজার টাকার ঔষধ কিনতে হয়েছে। আমার এখনও লাখ টাকার বেশি ঋণ। আমার বয়স হয়েছে।

তেমন কোন কাজ করতে পারি না। আমি ঋণ পরিশোধ করবো? নাকি সবাই মিলে খেয়ে পরে বেঁচে থাকবো? সরকারের প্রতি আমি আহবান জানাবো, দেশের জন্য আমার ছেলে শহিদ হয়েছে, আমার নাতিনটার দিকে তাকিয়ে যেন কিছু একটা করা হয়। যাতে আমরা খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারি।

নয়নের স্ত্রী আরজু বেগম বলেন, আমার স্বামী খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। নামাজ পড়তেন। আমাদের সংসারে অভাব থাকলেও সবাই মিলেমিশে থাকতাম। একটু ভালো ভাবে চলার জন্য আমি নিজেও সেলাইয়ের কাজি করি। কিন্তু আল্লাহ আমার কপালে সুখ লিখে রাখেনি, তাই স্বামীকে অসময়ে হারাতে হয়েছে।

তিনি বলেন, মেয়েটা সব সময় বলে আব্বু বিদেশে গেছে, ফিরে আসবে। নয়ন মারা যাওয়ার আগে আমাকে ও মেয়েকে আমার শ্বশুরের হাতে তুলে দিয়ে গেছে। বলে গেছে, ‘ওদের দেইখা রাইখো’। তাই আব্বা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমি রাজি হয়েছি। আমার বাবার বাড়ির অবস্থাও ভালো না। আমি মেয়েকে নিয়ে কি করতাম। আমাদের জন্য, মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন ভাই।