শিরোনাম
প্রতিবেদন: মো. জিয়াউর রহমান
ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ছেলে এসে ঔষধ খাওয়াবে এই আশায় এখনো পথ চেয়ে বসে থাকেন শহিদ নাদিমুল হাসান এলেমের মা।
মা ইসমত আরা বেগম(৩৮) হার্টের রোগী। মাকে প্রতিদিন সময়মতো ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতেন এবং নিজ হাতে ঔষধও খাওয়াতেন এলেম। সেই সন্তানকে হারিয়ে বিমর্ষ, শোকাহত মা এখনো অপেক্ষা করেন তার ছেলে এসে ঔষধ খাওয়াবে এবং চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবে।
গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার দুপুর বেলা জুমু’আর নামাজের পরে তাড়াহুড়ো করে কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জের তেলঘাট নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান নাজিমুল হাসান এলেম (২৪)।
পুরনো ঢাকার লক্ষ্মী বাজারে ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। সেই আন্দোলনের মিছিলে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি করে।
সে সময় মিছিলকারীরা দৌড়ে গিয়ে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে বের হয়ে পুনরায় মিছিল শুরু করলে পুলিশ আবারও গুলি শুরু করে। তখন দুপুর আড়াইটা। হঠাৎ গুলি এসে নাদিমুল হাসানের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিক থেকে বের হয়ে যায়। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের কালিগঞ্জ তেলঘাটের স্থায়ী বাসিন্দা শহিদ এলেমের বাবা শাহ আলম(৫০) বাসসকে এই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিন ছেলের মধ্যে নাদিমুল হাসান এলেম ছিলেন বড় সন্তান। তাইতো তার সংসারের প্রতি ছিল অনেক দায়িত্ববোধ।
সেই দায়িত্ব পালনে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পরই নাদিমুল হাসান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। সেখানকার আয় দিয়ে সংসারে বাবাকে সহযোগিতা করতেন এবং সময়মতো হৃদরোগী মায়ের জন্য ঔষধ কিনে আনতেন।
তার বাবা বলেন, ‘নাদিমুল হাসান এলেম আমার সংসারের প্রতি অনেক দায়িত্ববান ছিল। সবসময় দেশের উন্নতির কথা বলতো।’
বাবা শাহ আলম অনেক সময় সতর্ক করে সন্তানকে বলতেন, এত বেশি দেশ নিয়ে ভাবা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। তখন শহিদ এলেম জবাব দিত, বাবা সবাই যদি চুপ করে যায় আমাদের দেশটা কি ভালো হবে? কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে। বাবা তখন আর কথা বাড়াতেন না।
এই দায়িত্ববোধ থেকেই ছাত্রদের ওপর অত্যাচার এলেম সইতে পারেননি। বিবেকের তাড়নায় ছুটে গিয়েছিলেন পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের ছাত্র আন্দোলনে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। নাদিমুল হাসান এলেমের ফুফু বলেছিল,‘বাবা আজ খিচুড়ি রান্না করেছি। দুপুরে খাইয়া যাইস।’
ফুফুর জোরাজুরিতে অল্প একটু খিচুড়ি খেয়েই নাদিমুল হাসান তাড়াতাড়ি করে আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে যান।
তার বাবা বলেন, সন্ধ্যার দিকে মুঠোফোনে এলেমের মাকে কোন এক ব্যক্তি বলে আপনার ছেলে গুলি খেয়েছে। সে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে আছে।
খবর পেয়ে দ্রুত মিটফোর্ড হাসপাতালে ছুটে যান শাহ আলম। সেখানে গিয়ে দেখতে পান একটি তরতাজা যুবকের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। চোখে গুলি লাগায় এলেমের চেহারা রক্তাক্ত হয়ে যায়। ফলে তাকে চিনতে কিছুটা কষ্ট হয় তার পিতার। শহিদ এলেম সেদিন সাদা টি শার্ট পরে বের হয়েছিলেন। সেই টি-শার্টটি রক্তে ভিজে লাল হয়ে গিয়েছিল। সন্তানের দেহ নাড়াচাড়া করে বুঝতে পারেন এটাই তার বড় ছেলে নাদিমুল হাসান এলেম। তখন তার বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানকার এক লোক তাকে বলেন, তাড়াতাড়ি লাশ নিয়ে যান। নতুবা এই লাশ গুম হয়ে যাবে।
বাবা তখন লাশ আনতে চাইলে সেখানকার কর্তৃপক্ষ পুলিশের ছাড়পত্র আনতে বলেন। পুলিশের অনুমতি আনতে গিয়ে সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, গেন্ডারিয়া থানায় ছুটাছুটি করতে থাকেন শহিদ এলেমের বাবা। ছাড়পত্র আনতে গিয়ে সেদিন তিনি পুলিশের চরম দুর্ব্যবহারের শিকার হন।
মর্গে পড়ে রয়েছে পুত্রের লাশ বাবা ছুটছেন থানায় থানায়। সেদিনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মমতা ইতিহাসের যে কোন জঘন্য নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে। অবশেষে বিভিন্ন দেন-দরবার করে শহিদ এলেমের লাশ আনা হয় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কালিগঞ্জ তেলঘাট এলাকার নিজ বাসায়। রাত সাড়ে বারোটায় লাশ আনলে এলাকার আওয়ামী লীগের দলীয় গুণ্ডারা তাড়াতাড়ি লাশ দাফনের জন্য চাপ দিতে থাকে। তাই শহিদ এলেমের লাশ সে রাতেই কালিগঞ্জ খেজুর বাগ কবরস্থানে দাফন করা হয়। লাশ দাফনের পর পুলিশের পক্ষ থেকে শুভাঢ্যা ইউপি চেয়্যারম্যানের মাধ্যমে এলেমের বাবাকে এ নিয়ে বেশি কান্নাকাটি করতে বারণ করা হয়। এলাকার লোকজন যেন বাড়িতে জড়ো না হয় সেকথা বলে যায়। বাড়ির রাস্তার আশেপাশে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের গুণ্ডাবাহিনী মহড়া দিতে থাকে।
আপনজন হারানোর বেদনা নিয়েই নীরব থাকতে হয় শহিদ এলেমের পরিবারকে। গত ৫ ই আগস্ট খুনি স্বৈরাচার হাসিনার পতন হলে তখন আবেগ খুলে কান্নার সুযোগ পান তারা।
এলেমের বাবা বলেন, সন্তানকে হারিয়ে সেদিন থেকেই তার স্ত্রী আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
শহিদ এলেমের মাকে হার্টে তিনটি রিং পরানো হয়েছে। এখন চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন ওপেন হার্ট সার্জারি করাতে হবে। এলেমের মা ইসমত আরা সন্তানকে হারানোর বেদনায় কিছুতেই সার্জারি করতে রাজি হচ্ছেন না বলে জানান শাহ আলম।
এদিকে এ পরিবারকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির পক্ষ থেকে দুই লক্ষ টাকা এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় কালিগঞ্জ বাজারে ক্ষুদ্র কাপড়ের ব্যবসায়ী শাহ আলম তার শহিদ সন্তানের নামে কালিগঞ্জ তেলঘাট থেকে বয়েজ ক্লাব পর্যন্ত সড়কের নামকরণের দাবি জানান ।
এতে তার শোক কিছুটা লাঘব এবং দেশের জন্য কাজ করতে আগামী প্রজন্ম আরো উদ্বুদ্ধ হবে বলে তিনি মনে করেন।