বাংলাদেশ নারী হকি দলের দুই কান্ডারি সাতক্ষীরার রেহানা ও ষষ্ঠী

বাসস
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:১৪ আপডেট: : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:১৭

সাতক্ষীরা, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ফুটবল ও ক্রিকেটের পর হকিতেও ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মেয়েরা দারুনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘরোয়া আসর পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পা রাখতে শুরু করেছে বাংলাদেশের নারী হকি দল।

এ বছর জুলাইয়ে চীনের দাজহুতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৮ এশিয়া কাপ হকিতে প্রথমবারের মত অংশ নিয়ে ৩য় স্থান অধিকার করে বাংলাদেশের নারীরা। টুর্নামেন্টটিতে প্রথমবার অংশ নিয়েই দেশের জন্য সাফল্য বয়ে এনেছে ব্রোঞ্জজয়ী বাংলাদেশ নারী হকি দল।

স্থান নির্ধারনী ম্যাচটিতে কাজাখাস্তানকে ৬-২ গোলে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জয় করে বাংলাদেশ দল। এই দলে ছিলেন সাতক্ষীরার সুন্দবনঘেঁষা উপকুলীয় উপজেলা শ্যামনগরের দুই বাঘিনী কন্যা রেহানা ও ষষ্ঠী। দরিদ্র পরিবারের এ দুই কন্যা জীবনযুদ্ধে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজ তারা জাতীয় নারী হকি দলের খেলোয়াড় হিসেবে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নিয়ে  জেলার সুনাম রক্ষা করলেন।

১৫ বছর বয়সী রেহানা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা সদরের হায়বাতপুর গ্রামের চায়ের দোকানদার কওছার আলীর মেয়ে এবং ১৬ বছর বয়সী ষষ্ঠী একই উপজেলার কাশিমাড়ী ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামের দরীদ্র কৃষক সুকান্ত রায়ের কন্যা।

রেহানা জানান, জীবনের শুরুটা ছিল খুবই কঠিন। বাবার সামান্য আয়ে সংসার চালানোর পর আমার লেখাপড়ার খরচ যোগানো বাবার জন্য খুবই কষ্ট সাধ্য ছিল। তবে ছোট বেলা থেকে ফুটবল খেলার প্রতি তার ব্যাপক নেশা ছিল। সব সময় ইচ্ছা ছিল ভাল একজন খেলোয়াড় হওয়ার। স্থানীয় ১৩ নং হায়বাতপুর প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান লাভলু তাকে জেলার বিভিন্ন জায়গায় স্কুল পর্যায়ের খেলায় অংশ গ্রহন করার সুযোগ কওে দেন। এরপর ষষ্ঠ শেনীতে ওঠার পর নকিপুর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন। সেখানে শিক্ষক কৃষ্ণনন্দ মূখার্জি তাকে বিভিন্ন জায়গায় ইন্টার স্কুল পর্যায়ে খেলার জন্য নিয়ে যেতেন। প্রতিটি খেলায় ১ম অথবা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতেন তিনি। 

এছাড়া তিনি স্থানীয় শ্যামনগর ফুটবল একাডেমীর কোচ আক্তার হোসেনের কাছে ফুটবল অনুশীলন করতেন। এক পর্যায়ে কোচ আক্তার হোসেনের অনুপ্রেরনায় ২০২৩ সালে খুলনা আঞ্চলিক বিকেএসপিতে ফুটবলে ট্রায়াল দেন। সেখানে ফুটবল ও হকিতে একদিনের ট্রায়েল দেয়ার পর দুটোতেই সুযোগ পান। এরপর ৭ দিনের জন্য ফুটবল ক্যাম্পে যান। ক্যাম্প শেষে হকি কোচ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন রাজু তাকে হকির জন্য দুই তিনটি টেস্ট নিয়েছিলেন। ক্যাম্প শেষে বাড়িতে ছুটিতে চলে আসেন। একমাস পর মার্চে রেজাল্ট দেয়ার পর তিনি বিকেএসপিতে হকিতে ৭ম শ্রেনীতে ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি সেখানে নবম শ্রেনীতে অধ্যয়নরত আছেন। দীর্ঘ দুই বছর বিকেএসপিতে অনুশীলন করার পর অনূর্ধ্ব-১৮ এশিয়া কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন তিনি। তবে এই প্রথম বিদেশের মাটিতে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে তিনি দেশ বাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।

রেহেনার বাবা কওসার আলী জানান, তিনি নিজেও একজন ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় তিনি ফুটবল খেলতেন। ছিলেন একজন ভালো গোলরক্ষক। বাবার অনুপ্রেরনায় তার ছোট মেয়ে রেহানা খেলাধূলার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। শ্যামনগরের হায়বাতপুর মোড়ে তার একটি ছোট চায়ের দোকান রয়েছে। জায়গা জমি বলতে তার ভিটেবাড়িসহ সাড়ে ৬ শতক জমি ছাড়া আর কিছুই নেই। সারা দিন চা বিক্রি করে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে তিনি তার পরিবার নিয়ে কোন রকমে জীবনযাপন করেন। 

তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে ভারতে থাকেন। মেঝ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কাওসার আলী বলেন, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি তার ছোট মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন এবং বিকেএসপিতে ভর্তিও করেছেন। প্রথম দিকে স্থানীয় এলাকাবাসী তার মেয়ে প্যান্ট ও জার্সি পরে খেলাধুলা করলে অনেক ধরনের কটু কথা বলতেন। মেয়ে মানুষ কেন হাফ প্যান্ট পরে খেলাধুলা করবে ? এ ধরনের নানা প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে তিনি তার মেয়েকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। দেশবাসীর কাছে মেয়ের জন্য দোয়া চেয়ে কাওসার আলী প্রতাশা করেন আগামীতে রেহানা যেন আরো ভালো খেলে দেশের জন্য আরো ভালো কিছু করতে পারেন। একই সাথে তিনি সরকারের কাছে তার পরিবারের জন্য সহযোগিতা কামনা করেন।

এদিকে একই উপজেলার আরেক বাঘিনী কন্যা ষষ্ঠী রায় জানান, বাবা সুকান্ত রায়ের ৪ কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান। তার বাবা গ্রামের একজন হতদরিদ্র কৃষক। নিজের এক বিঘা জমিতে কৃষি কাজ করে পরিবার পরিজন নিয়ে খুবই কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষিকাজে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চালানোর পর অনেক পরিশ্রম করে তার বাবা তাকে লেখা পড়া শিখিয়েছেন। 

তবে ছোটবেলা থেকে সব খেলার প্রতি তার খুবই আগ্রহ ছিল। স্থানীয় খুটিকাটা সরকারী প্রাাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্কুল পর্যায়ের সব খেলায় অংশ গ্রহন করতেন তিনি। সেখানে তিনি বেশ কিছু পুরস্কারও জয় করেছেন। এরপর স্থানীয় কাঁঠালবাড়িয়া এ.জি মাধ্যমিক বিদ্যালয় লেখাপড়া শুরু করেন। সেখানেও ইন্টার স্কুল পর্যায়ে সব খেলায় অংশ গ্রহন করেছেন। স্কুলের ক্যাপ্টেনও ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে খুলনা আঞ্চলিক বিকেএসপিতে ফুটবল ও হকিতে ট্রায়াল দেয়ার পর ঢাকাতে ৭ দিনের ক্যাম্প শেষ করে ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিকেএসপিতে হকিতে ৭ম শ্রেনীতে ভর্তিও সুযোগ পান। বিকেএসপি থেকে তিনি এবার এসএসসিতে ৪.৬৭ পেয়ে কৃতকার্য হয়েছেন। 

ষষ্ঠীর বাবা কৃষক সুকান্ত রায় জানান, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় ষষ্ঠী অংশগ্রহণ করতে পেরেছে, এজন্য আমি অনেক খুশী। অনেক কষ্টে তাকে বড় করেছি। তারপরও সবকিছুর বিনিময়ে তিনি তার মেয়ের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি চান তার মেয়ে যেন আর ভালো খেলে দেশকে সামনের দিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। তিনি এসময় দেশবাসীর কাছে তার মেয়ে ষষ্ঠির জন্য আশীর্বাদ কামনা করেন।

এশিয়া কাপ হকিতে অংশগ্রহণ শেষে দেশে ফিরে আসার পর রেহানা ও ষষ্ঠীকে শ্যামনগরের উপজেলা প্রশাসন, শ্যামনগর ফুটবল একাডেমীসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
জাম্বিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সশ্রম কারাদণ্ড
ইয়েমেনে ইসরাইলের গুপ্তচর সন্দেহে জাতিসংঘ কর্মী আটক: হুতি কর্মকর্তা
নীলফামারী উত্তরা ইপিজেডে কাজে যোগ দিয়েছে শ্রমিকরা
শরীয়তপুরে কমিউিনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম জোরদারকরণ বিষয়ক সেমিনার
বেইজিংয়ে সি চিনপিংয়ের সঙ্গে কিম জং উনের বৈঠক
তারেক রহমান দেশে ফিরতে চাইলে ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্রে সহযোগিতা করবে সরকার: তৌহিদ
ঝালকাঠিতে স্কাউট সদস্যদের সনদ বিতরণ
বাংলাদেশে এসডিজি অর্জনে তৃণমূল নেতৃত্বের ওপর জোর বিশেষজ্ঞদের
সিলেটে বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য জব্দ
আফগানিস্তানে ভূমিকম্প দুর্গতদের জন্য বিজিএমইএ’র জরুরি মানবিক সহায়তা
১০