ঢাকা, ১৪ মে, ২০২৫ (বাসস) : ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল, কম কফি বা অ্যালকোহল—জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেড়ে চলা তাপমাত্রা মানুষের ঘুমের মান ক্ষুণ্ন করছে। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের এই গরম পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখতে হবে।
মানব মস্তিষ্ক তাপের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে শরীরের অভ্যন্তরীণ থার্মোস্ট্যাট উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং দেহের চাপ সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া সক্রিয় হয়।
প্যারিস থেকে এএফপি জানায়, বিজ্ঞানীরা এখন ক্রমাগত এমন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন, যা ঘুমে প্রভাব ফেলছে এমন গরম পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে এবং স্বাস্থ্য জটিলতা এড়াতে পারে।
২০২৪ সালে স্লিপ মেডিসিন সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনা নিবন্ধে বলা হয়েছে, 'জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়ণের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানুষের ঘুম এবং এর ফলে স্বাস্থ্য, কর্মক্ষমতা ও মানসিক সুস্থতার ওপর বৈশ্বিক হুমকি তৈরি করছে।'
ওয়ান আর্থ নামের আরেকটি সাময়িকীতে ২০২২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে গড়পড়তায় প্রতি বছর মানুষের ঘুমের সময় ৪৪ ঘণ্টা কমে গেছে, যার পেছনে অন্যতম কারণ হলো উষ্ণতা বৃদ্ধি।
কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কেল্টন মাইনর ৪৭টি দেশের ৬৮ হাজারের বেশি মানুষের ঘুমের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে ২০৯৯ সালের মধ্যে একজন মানুষ বছরে ৫০ থেকে ৫৮ ঘণ্টা ঘুম হারাতে পারে।
মাইনর ও তার সহ-গবেষকরা বলেন, 'এখন হস্তক্ষেপমূলক গবেষণা ও মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে মানুষ উষ্ণ পৃথিবীতে মানিয়ে নিতে পারে এবং ঘুমের পুনরুদ্ধার ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখা যায়।'
তাপমাত্রা ও ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী নিউরনগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। ঘুমের মান বাড়াতে হলে দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমানো গুরুত্বপূর্ণ।
গরমে মানিয়ে নিতে হয়রানি বাড়ে
প্যারিস সিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফাবিয়ান সোভে বলেন, 'গরমে আমাদের ঘাম বেশি ও দ্রুত হয়। এটি শরীরে বাড়তি পানির চাহিদা তৈরি করে এবং এর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। তাই তাপপ্রবাহের সময় আমাদের আচরণ, সময়সূচি ও পোশাকের ধরনে পরিবর্তন আনা সবচেয়ে জরুরি।'
তবে মানুষ ধারণার চেয়েও বেশি তাপ সহ্য করতে পারে বলে তিনি মনে করেন। বেশ কিছু গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৮২.৪ ফারেনহাইট) তাপমাত্রাতেও ভালো ঘুম সম্ভব।
তিনি বলেন, 'বেডরুমের তাপমাত্রা ১৮-২০ ডিগ্রিতেই থাকতে হবে—এ ধারণা ভুল।' হালকা পোশাক, যেমন টি-শার্ট ও শর্টস পরে ঘুমানো, পাতলা চাদর ব্যবহার এবং ঘরের সঠিক বায়ুচলাচল ঘুমের মান বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে।
'যদি আমরা সবসময় এসি চালিয়ে ঘুমাই, তাহলে আমাদের দেহ কখনোই গরমের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না,' বলেন তিনি।
‘ঘুমের শত্রু’ রুখতে হবে
সেন্টার ফর ইন্টারডিসিপ্লিনারি রিসার্চ ইন বায়োলজির স্নায়ুবিজ্ঞানী আর্মেল রঁসিয়াক বলেন, '২৮ ডিগ্রির বেশি হলে ঘুমের মান বজায় রাখা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।'
প্রচণ্ড ঘুমের ঘাটতি শরীরের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে।
স্বল্পমেয়াদে এটি তন্দ্রাচ্ছন্নতা, ক্লান্তি এবং কর্মক্ষেত্র বা রাস্তায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদে এটি ঘুমের ‘ঋণ’ সৃষ্টি করে, যা বিপাকক্রিয়া বিঘ্নিত করে এবং ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এমনকি অ্যালঝেইমারের মতো স্নায়ুবিক ব্যাধির ঝুঁকি বাড়ায়।
ঘুমের ঘাটতি মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতাও কমিয়ে দেয় এবং মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ করে।
তাই গরমের মধ্যে ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে ‘ঘুমের শত্রু’দের চিহ্নিত করে সেগুলো থেকে দূরে থাকা জরুরি বলে মনে করেন রঁসিয়াক।
ঘুমানোর আগে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল (তবে বরফ ঠান্ডা নয়), কফি ও উত্তেজক পানীয় কম খাওয়া এবং অ্যালকোহল পরিহার করা—এসব ঘুমের মান উন্নত করতে সহায়ক। কারণ, অ্যালকোহল ঘুম পেতে সাহায্য করলেও এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা সামান্য বাড়িয়ে দেয়।
ওয়ার্কআউটের পর গরম পানিতে না নেমে ঠান্ডা পানি বা বাইরের তাপমাত্রায় স্নান করার পরামর্শ দেন সোভে।
ঘুমের ঘাটতি কাটাতে দিনের সবচেয়ে গরম সময়টাতে ছোট ছোট ‘ন্যাপ’ বা ঘুম যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে।
তবে এটি হতে হবে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে এবং বিকেল ২টার আগেই, যেন রাতের ঘুমের ওপর প্রভাব না পড়ে।