বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট গ্রহণের আদেশ স্থগিত

বাসস
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৫, ১২:৩৫ আপডেট: : ২৯ জুন ২০২৫, ১৫:৪৮

ঢাকা, ২৯ জুন, ২০২৫ (বাসস) : নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা বিধির গেজেট গ্রহণ সংক্রান্ত ২০১৮ সালের আপিল বিভাগের আদেশ আজ স্থগিত করা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির বেঞ্চ, এ রিভিউ শুনানি শেষে গেজেট গ্রহণের সেই আদেশ স্থগিত করে পাশাপাশি এ বিষয়ে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন।

আদালতে রিভিউ আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

আজকের আদেশের পর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছেন, ‘২০১৮ সালে গেজেট গ্রহণের আদেশ স্থগিত হওয়ায়, অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ নং অনুচ্ছেদ বিষয়ক হাইকোর্টে চলমান রুল শুনানি ও নিষ্পত্তিতে আর কোনো বাধা রইল না। একই সঙ্গে গেজেট কার্যকর থাকায় কোনো প্রশাসনিক শূন্যতাও সৃষ্টি হবে না।’

গেজেট গ্রহণ নিয়ে দ্বন্দ্ব ও ইতিহাস

গেজেট প্রকাশের আগে বিধিমালা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। আইন মন্ত্রণালয় শৃঙ্খলাবিধির খসড়া তৈরি করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠালে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আপত্তি জানান। তিনি বলেছেন, ‘খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি।’

কিছু শব্দ ও বিধি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। খসড়া সংশোধন করে আবার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারে মতপার্থক্যের কারণে গেজেট প্রকাশ স্থগিত থাকে। এ সময় ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের  সমালোচনার মুখে প্রধান বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে দেশ ত্যাগ করেন ও পরে পদত্যাগপত্র দেন।

এরপর ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগ অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধি গেজেট আকারে গ্রহণ করে আদেশ দিয়েছিল। ওই আদেশের বিরুদ্ধে আটজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রিভিউ আবেদন করেন।

সেই সময় ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, মইনুল হোসেন, এ এফ হাসান আরিফ ও ফিদা এম কামালসহ সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবীরা, বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব বিস্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

মাসদার হোসেন মামলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

এই বিতর্কের মূলে রয়েছে ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলা। ১৯৯৪ সালে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বেতন গ্রেড একধাপ নামিয়ে দেওয়া হলে তৎকালীন জেলা জজ ও জুডিশিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাসদার হোসেনসহ ২১৮ জন বিচারক হাইকোর্টে রিট করেন।

এই রিটের শুনানির পর ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট অধস্তন আদালতের বিচারকদের বেতন গ্রেড নামিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করে বিচারকদের বিসিএস ক্যাডারভুক্ত করার বৈধতার প্রশ্নে রুল জারি করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ৭ মে রুল যথাযথ ঘোষণা করে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস করার রায় দেন। তবে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। সে আপিলের শুনানি শেষে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার চূড়ান্ত রায় দেন।

সেই নির্দেশনাগুলোর মধ্যে ছিল-

১) সংবিধানের ১৫২(১) অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের অন্তর্ভুক্ত, তবে বিচার বিভাগ অন্যান্য সিভিল সার্ভিস থেকে স্বতন্ত্র হবে।

২) বিচারিক হাকিমদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হবে, আর নির্বাহী বিভাগের হাকিমরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না।

৩) বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একই সঙ্গে সব হাকিম নিয়োগ সংবিধান পরিপন্থি।

৪) দ্রুত জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠন ও বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

৫) সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারিকদের চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।

৬) রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন।

৭) সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।

৮) বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে, জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না।

৯) জুডিশিয়ারির বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন ও বরাদ্দ করবে সুপ্রীম কোর্ট, নির্বাহী বিভাগ কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।

১০) জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।

১১) বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য সংবিধানে সংশোধনের প্রয়োজন নেই, তবে প্রয়োজনে করা যাবে।

১২) জুডিশিয়াল পে-কমিশন থেকে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করা পর্যন্ত, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা বিদ্যমান কাঠামো অনুযায়ী তাদের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে থাকবেন।

ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আট বছর পর ২০০৭ সালে এই নির্দেশনার মূল অংশ বাস্তবায়িত হয় এবং বিচার বিভাগ আলাদা করা হয়, কিন্তু শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়নের বিষয়টি ঝুলে থাকে।

গত বৃহস্পতিবার রিভিউ শুনানিতে আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুনানিতে বলেছি বিচার বিভাগকে ‘অ্যাসল্ট করে’ এই শৃঙ্খলাবিধিকে গ্রহণ করা হয়েছিল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে। কারন, তার আগে নয়জন বিচারপতি এ বিষয়ে ভিন্ন আদেশ দিয়েছিলেন। এটি বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে তৎকালীন সরকার বাধ্য করেছিল নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের গেজেট সংক্রান্ত আদেশ দিতে। এটি দ্রুত রিভিউ করা প্রয়োজন বলেই আদালতের অনুমতি নিয়ে রিভিউটি করা হয়।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
শিক্ষার্থীদের আবাসন ভাতাসহ চার দফা দাবি ঢাবি শিবিরের 
আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে শাস্তির কবলে সামি
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে ফিরে আসার আহ্বান - সংকট নিরসনে সরকারের বিবৃতি
কথিত আওয়ামী লীগ সমর্থক নির্যাতনের ভাইরাল ভিডিওটি ভুয়া : প্রেস উইং
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস
গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে : প্রেস উইং
বিলুপ্তির পথে শতাব্দী প্রাচীন তামা-কাঁসা শিল্প
ঝিনাইদহে খেজুর বীজ থেকে তৈরি হচ্ছে অভিনব পানীয়
বিএনপি মহাসচিবের সাথে বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনারের সৌজন্য সাক্ষাৎ
‘ক্যাপিটালাইজার ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিযোগিতার চূড়ান্তপর্ব ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান
১০