হাবিবুর রহমান
ঢাকা, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : অল্প সময়ে, স্বল্প খরচে, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে দেশের ৬১ জেলায় গ্রাম আদালতের কার্যক্রম চলছে। এই আদালতে মাত্র ১০ টাকা ফি দিয়ে ফৌজদারি মামলা এবং ২০ টাকা ফি দিয়ে দেওয়ানী মামলার আবেদন করা যায়। আইনে ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাম আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করার বিধান থাকলেও গড়ে ২৮ দিনে এই মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণ বিশেষ করে নারী, প্রতিবন্ধী এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খুব সহজে গ্রাম আদালতে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ পাচ্ছে। একইসাথে দুটি পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। মূলত গ্রাম আদালত সম্পর্কে না জানার কারণে মানুষ ছোট ছোট বিরোধ নিয়ে থানায় ও আদালতে মামলা করতে যাচ্ছে। তাদের মতে, গ্রাম আদালত ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে আদালতের ওপর চাপ কমবে। মানুষ স্বল্প সময়ে ও সহজে বিচার পাবে। একই সাথে মামলার জট হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ-৩য় পর্যায় প্রকল্প-স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি প্রকল্প। এটি বাংলাদেশ সরকার, ইউএনডিপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য প্রকল্প, যার লক্ষ্য কার্যকরী স্থানীয় বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া হিসেবে সারা দেশে গ্রাম আদালত ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা।
এ বিষয়ে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ- ৩য় পর্যায় স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রকল্পের লিগ্যাল অ্যানালিস্ট মশিউর রহমান চৌধুরী বাসসকে বলেন, দেশের ৬১টি জেলায় এখন গ্রাম আদালত ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। এটাকে আরো সক্রিয় করতে আমরা নানা উদ্যোগ নিচ্ছি। মূলত মানুষ গ্রাম আদালত সম্পর্কে জানে না, এ কারণেই এই আদালতে দায়ের যোগ্য মামলা থানায় ও আদালতে দায়ের করছে। তিনি বলেন, গ্রাম আদালতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। আইনে ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির কথা থাকলেও গড়ে মাত্র ২৮ দিনে মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এই আদালতের উদ্দেশ্য বিরোধ নিষ্পত্তি করা। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করা। দুই পক্ষকে মিলিয়ে দেওয়াই গ্রাম আদালতের উদ্দেশ্য। গ্রাম আদালতে নিজের ইউনিয়নে অবস্থান করেই মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে। এতে থানা ও আদালতে যেতে যে বাড়তি খরচ ও সময় ব্যয় হয় সেটা হয় না।
গ্রাম আদালত: গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে কতিপয় ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিরোধের সহজ ও দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত গঠিত হয়।
গ্রাম আদালত অনধিক ৩ লাখ টাকা মূল্যমানের ফৌজদারি ও দেওয়ানী বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে। এছাড়া গ্রাম আদালতে আইনজীবী নিয়োগের বিধান নেই।
গ্রাম আদালতে যেভাবে আবেদন করা যায়: গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করতে আবেদনকারীকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আবেদন ফরম সংগ্রহ করে যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে। আবেদনপত্র ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর দাখিল করতে হবে। আবেদনপত্র দাখিলের সময় ফৌজদারি মামলার জন্য ১০ টাকা এবং দেওয়ানি মামলার জন্য ২০ টাকা ফি জমা দিয়ে রসিদ সংগ্রহ করতে হবে। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে বিরোধ সংঘটিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন করতে হবে। দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে বিরোধ সংঘটিত হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করতে হবে। তবে স্থাবর সম্পত্তি বেদখল হওয়ার দিন থেকে ১ বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করা যাবে।
গ্রাম আদালত যেভাবে গ্রামের জনগণকে সহায়তা করতে পারে: গ্রাম আদালত হলো স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ বা বিবাদ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা যা ন্যায্য বিচার লাভে সহায়তা করে। গ্রাম আদালতে সবাই অল্প সময়ে, স্বল্প খরচে এবং অতি সহজে প্রতিকার পায়। গ্রাম আদালতে আবেদনপত্র দাখিলের ফি ছাড়া অন্য কোনো খরচ নেই। গ্রাম আনালত উচ্চতর আদালতের মামলার জট কমাতে সাহায্য করে।
গ্রাম আদালতে যেসব সুযোগ রয়েছে: গ্রাম আদালতে অল্প সময়ে, স্বল্প খরচে এবং অতি সহজে বিরোধ ও বিবাদ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। প্রতিনিধি মনোনয়নে আবেদনকারী ও বিবাদী সমান সুযোগ পায়। বাদী ও বিবাদী পক্ষগণ নিজের কথা নিজে বলতে পারে, আইনজীবী দরকার হয় না। গ্রাম আদালতে সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়, এক বিরোধ থেকে অন্য বিরোধ সৃষ্টির সম্ভাবনা কম থাকে। দুটি পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণ বিশেষ করে নারী, প্রতিবন্ধী এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খুব সহজে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ পায়।
গ্রাম আদালত যেসব বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে: ফৌজদারি মামলা। যেমন- চুরি, দাঙ্গা, প্রতারণা, ঝগড়া বিবাদ, কলহ বা মারামারি, মূল্যবান সম্পত্তি আত্মসাৎ করা। অন্যায় নিয়ন্ত্রণ ও অন্যায় আটক। ভয়ভীতি দেখানো বা হুমকি দেয়া। কোন নারীর শালীনতাকে অমর্যাদা বা অপমানের উদ্দেশ্যে কথা বলা, অঙ্গভঙ্গি করা বা অন্য কোনো কাজ করা।
দেওয়ানি মামলা, যেমন: পাওনা টাকা আদায় সংক্রান্ত। স্থাবর সম্পত্তি দখল পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত। অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায় সংক্রান্ত। কোনো অস্থাবর সম্পত্তি জবর দখল বা ক্ষতি করার জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় সংক্রান্ত। গবাদিপশুর অনধিকার প্রবেশের কারণে ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত। কৃষি শ্রমিকদের পরিশোধযোগ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ আদায় সংক্রান্ত। স্ত্রী কর্তৃক বকেয়া ভরণপোষণ আদায় ইত্যাদি।
গ্রাম আদালত যেসব বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারবে না: ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, ডাকাতি, বহুবিবাহ, তালাক, অভিভাবকত্ব, দেনমোহর, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন, কোনো ঘটনায় রক্তপাত ঘটে থাকলে, স্থাবর সম্পত্তির স্বত্বাধিকার সংক্রান্ত এবং ৩ লাখ টাকার অধিক মূল্যমানের যে কোনো বিরোধ গ্রাম আদালত নিষ্পত্তি করতে পারবে না।
গ্রাম আদালত গঠন: একজন চেয়ারম্যান এবং উভয়পক্ষ (আবেদনকারী এবং প্রতিবাদী) কর্তৃক মনোনীত ২ জন করে মোট পার্টজন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে প্যানেল চেয়ারম্যান বা ইউনিয়ন পরিষদের অন্য কোনো সদস্য গ্রাম আদালতের দায়িত্ব পালন করবেন। নারী সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রাম আদালতে প্যানেল সদস্য হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক।
গ্রাম আদালত কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কত টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে:
মিথ্যা মামলা দায়ের করলে: গ্রাম আদালতে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হলে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকে অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারে।
সাক্ষী কর্তৃক সমন অমান্য করলে: গ্রাম আদালত কর্তৃক জারিকৃত সমন সাক্ষী ইচ্ছা করে অমান্য করলে, গ্রাম আদালত ঐ সমন অমান্যকারী সাক্ষীকে অনধিক ১ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে।
আদালত অবমাননা করলে: কোনো ব্যক্তি যদি গ্রাম আদালত অবমাননা করে তাহলে অনধিক ১ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারে।
যেসব বিষয়গুলো গ্রাম আদালত অবমাননার শামিল: গ্রাম আদালত সম্পর্কে অশালীন কথা বলা বা হুমকি দেয়া। গ্রাম আদালতের কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা। গ্রাম আদালতের আদেশ সত্ত্বেও কোনো দলিল বা অর্পণ বা হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হওয়া। আদালতের কাছে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করা।