শিরোনাম
লালমনিরহাট, ৭ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : লালমনিরহাট ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল জেলার ৫ উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলাসহ প্রায় ১৬ লাখ মানুষ এ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল।
১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হিসেবে উন্নীতকরণ করা হলেও সেবার মান এখনো সন্তোষজনক নয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে ২০১৭ সালে নভেম্বর মাসে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
২০১৯ সালে ভবনটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কয়েকবার সময় বাড়ানোর পর ২০২৩ সালে প্রাথমিকভাবে ভবনের কাজ শেষ হয়। তবে ৬ -৭ বছর সময় লেগে গেলেও এখন পর্যন্ত জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে নতুন ভবনের উল্লেখযোগ্য কোন কার্যক্রমেই শুরু হয়নি ।
গতকাল বুধবার ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের বিছানা স্বল্পতায় মেঝেতে ও বারান্দায় বিছানা করে শুয়ে আছেন অনেক মুমূর্ষু রোগী। এ হাসপাতালে পুরুষ রোগী থেকে নারী রোগীর সংখ্যা তুলনামূল অনেকটাই বেশি।
রোগীদের অভিযোগ রোগ নির্ণয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরের ক্লিনিকে তাদেরকে যেতে হচ্ছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় ব্যহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। এছাড়াও সুইপার সংকটের কারণেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা আবজর্না। এ অবস্থায় চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে অভিযোগের কমতি নেই ভুক্তভোগীদের।
জানাগেছে ২৫০ শয্যার অবকাঠামো তৈরি হলেও ১০০ শয্যার অবকাঠামো ও জনবল দিয়ে চালানো হচ্ছে হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম।
শয্যা সংকটের কারণে এখনো পুরাতন ভবনের বারান্দা ও মেঝেতে থাকতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। এ হাসপাতালের প্রয়োজনীয় ওষুধ কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগ অনেক দিনের ।
এখানে উন্নত স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার সামান্য কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও ওষুধ থাকলেও সেসবের সুবিধা তেমন পাননা রোগীরা।
চিকিৎসকদের অবহেলা ও চিকিৎসক সংকটসহ নানান কারণে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত লালমনিরহাটের মানুষ।
এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে এলাকার লোকজন প্রতিবাদ করলেও তেমন কোন লাভ হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে লালমনিরহাটের কয়েকজন সাংবাদিক বলেন, বিগত সময় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মেডিকেল সংক্রান্ত নানান অনিয়ম ও চিকিৎসা সেবা নিয়ে সংবাদ প্রচার করা হলেও উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পরিবর্তন সম্ভব হয়নি।
অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালে ডাক্তারের সংখ্যা কম থাকায় ঠিকমতো চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে না অন্য চিকিৎসকরাও।
কেউ বেসরকারি ক্লিনিক নিয়ে ব্যস্ত কেউ আবার নিজস্ব ক্লিনিকের রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে ব্যস্ত।
হাসপাতালে জটিল অপারেশন তো পরের কথা ছোট কোন অপারেশন করতে হলে শুনতে হয় নানা অজুহাত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন কর্মচারী বলেন, এখানে আসা রোগীদের মোবাইল, নগদ টাকাসহ মূল্যবান সামগ্রি চুরির ঘটনাও যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে কমিশন ভিত্তিক দালাল। এখানে দালাল হিসেবে কাজ করছে বিভিন্ন ফার্মেসির কর্মচারী, অটো রিকশাচালক ও হাসপাতালের কয়েকজন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।
তিনি আরো বলেন, এখানে কিছু চিকিৎসক আছে যারা প্রাইভেট ক্লিনিকের সঙ্গে জড়িত। সেই সব ডাক্তারদের
এখানে পাওয়া না গেলেও তাদের নিজস্ব চেম্বারে ঠিকই পাওয়া যায়। আরো বলেন, চিকিৎসক সংকট ও আধুনিক চিকিৎসা সেবার যন্ত্রপাতির কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে । আরএ সুযোগে হাসপাতাল থেকে কমিশন ভিত্তিক
দালালরা রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যায় স্থানীয় প্রাইভেট ক্লিনিকসহ রংপুরের মালিকানাধীন ডায়গনোস্টিক সেন্টারগুলোতে।
লালমনিরহাট ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের ১০০ শয্যার জনবলের মঞ্জুরীকৃত রাজস্ব পদের চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের পদ সংখ্যা :
চিকিৎসক : সৃজনকৃত পদ সংখ্যা ৪১, পূরণকৃত পদসংখ্যা ১৯, শুন্য পদসংখ্যা ২২।
নার্সিং কর্মকর্তা : মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ৭৪ ,কর্মরত পদের সংখ্যা ৬২, শূন্য পদের সংখ্যা ১২।
তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী : মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ৩৩, কর্মরত পদের সংখ্যা ২৩, শূন্য পদের সংখ্যা ১০।
চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী: মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ২৪ ,কর্মরত পদের সংখ্যা ১৮, শূন্য পদের সংখ্যা ৬।
দ্বিতীয় শ্রেণীর জনবল : মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ১,কর্মরত পদের সংখ্যা ০ , শূন্য পদের সংখ্যা ১।
দ্বিতীয় শ্রেণীর পদের নাম: অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ।
সর্বমোট ১৭৩টি মঞ্জুরীকৃত রাজস্ব পদের বিপরীতে ১২১ জন কর্মরত রয়েছেন। চিকিৎসক, নার্সিং কর্মকর্তা , তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী,দ্বিতীয় শ্রেণীর জনবলসহ মোট এখনো ৫২ জন জনবলের সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে। গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক শূন্য পদগুলো হল:
সিনিয়র কন:(ই,এন,টি), সিনিয়র কন:(গাইনী),সিনিয়র কন:(সার্জারি), সিনিয়র কন:(শিশু), জুনি: কন:(চক্ষু), জুনিঃ কন:(রেডিওলজি), জুনি: কন:(অর্থো- সার্জারি),জুনি: কন:( প্যাথলজি),জুনি: কন: (ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহাবিলিটিটেশন),জুনিঃ কনঃ(চর্ম ও যৌন), মেডিকেল অফিসার, এমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার,রেডিওলজিস্ট, সহকারী সার্জন (আয়ুর্বেদিক), মেডিকেল অফিসার (হোমিও),টেন্ডাল সার্জন।
এখানে এলার্জি আক্রান্ত মেয়ের চিকিৎসা নিতে আসা লালমনিরহাট শহরের হাড়িভাঙ্গা এলাকার মোকলেজা বেগম(৪০) বলেন, সকাল ৯টায় এখানে এসেছি, দুপুর ১২ টা পার হলেও এখনো ডাক্তার দেখাতে পারিনি । ডাক্তার অনেক লেট করে আসায় মানুষের ভিড় অনেক বেশি। তিনি আরো বলেন, কয়েকদিন আগে আমার একজন নিকটতম আত্মীয় সিজার করানোর জন্য ভতির্ হন। ২ দিন থাকার পর চিকিৎসক জানান, এখানে সিজার করা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ তাই রোগীকে রংপুরে নিতে হবে । পরে আমাদের এলাকার একজন বয়স্ক মহিলার মাধ্যমে বাড়িতেই নরমাল ডেলিভারি হয় ।
আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ গোবদা গ্রামের খাইরুল ইসলাম (৪২) বলেন , বেলা ১১ টায় হাসপাতালে এসেছি ডাক্তার দেখানোর জন্য কিন্তু এর মধ্যেই এসে দেখি আমার বাইসাইকেল চুরি হয়ে গেছে । তিনি আরো বলেন,এখানে সাইকেল ও মোটরসাইকেল গ্যারেজ থাকলেও নেই কোন কর্তৃপক্ষ। এমতাবস্থায় কি করা উচিত বুঝতে পারছি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মচারী জানান , এ হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিভাগীয় শহর রংপুরে বসবাস করেন। সেখানে তারা বিভিন্ন ক্লিনিক, হাসপাতাল ও বেসরকারি মেডিকেলে সেবা দেন। অনেক সময় নানান অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নিয়ে অনুপস্থিত থাকেন তারা। এতে এ অঞ্চলের মানুষ কাক্সিক্ষত সেবা পান না।কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার বালারহাট ইউনিয়নের মকবুল আলী (৪৮) বলেন, সকাল ৯টায় অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে এসেছি কিন্তু দুপুর হয়ে গেলেও ডাক্তারের
দেখা পাইনি। সরকারি হাসপাতালে যদি চিকিৎসা না পাওয়া যায় তাহলে হাসপাতালে চিকিৎসক থেকে লাভ কি !
লালমনিরহাট সদরের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সাইদুল ইসলাম বলেন , আমি আমার এক আত্মীয়কে দেখতে এসেছি , এসে দেখি রোগীর বেহাল অবস্থা, ওষুধ নেই । বেড না পেয়ে বারান্দায় পড়ে আছে । সেখানে দুর্গন্ধ ,ময়লা, আবর্জনা সবকিছু মিলে খুব খারাপ পরিস্থিতি এ হাসপাতালের।
লালমনিরহাট ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আব্দুল মোকাদ্দেম বলেন, ১০০ শয্যা হাসপাতালেরই জনবল সংকট ছিলো। সেই জনবল দিয়েই ২৫০ শয্যা হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ভালো সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। জনবলের চাহিদা সহ আরো বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আর হাসপাতালের নতুন ভবনে রোগীদের বেড স্থাপন কার্যক্রম শুরু হলে বেড সংকট থাকবে না।