শিরোনাম
॥ আল-আমিন শাহরিয়ার ॥
ভোলা, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : দেশের দক্ষিণ জনপদের অনন্য সৌন্দর্যের এক নয়নাভিরাম তারুণ্যদ্বীপ্ত নিদর্শন তারুয়া দ্বীপ। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সাগর মোহনার ঢালচরের দক্ষিণে অবস্থিত ছোট্ট এ দ্বীপটি প্রকৃতির সু-নিপুণ নিখুঁত এক সৃষ্টি।
বঙ্গোপসাগরের কোলে প্রায় চার দশক আগে জেগে ওঠা এ দ্বীপের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য প্রতিনিয়ত ভ্রমণপিয়াসু পর্যটকদের মুগ্ধ করে তোলে। সবুজ বনভূমি, সোনালী সৈকত পাড়ে বালুর ঝলকানি, লাল কাঁকড়া বিচরণ সব মিলিয়ে এ দ্বীপটি যেনো প্রকৃতির এক অনন্য উপহার।
এ দ্বীপটিতে পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ যাত্রাপথ। ভোলা জেলা সদর থেকে প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার সড়কপথ এবং এরপর ১৫ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়ে তারুয়া দ্বীপের মোহনীয় রূপ চোখে পড়ে। দ্বীপের পথে যাত্রায় ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় সাগরের গর্জন, চারদিকে বিস্তৃত নীল জলরাশি, আর সবুজে ঘেরা দ্বীপের মোহণীয় দৃশ্য। মনে হয়, প্রকৃতিকে যেনো ভিন্ন রুপে সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে গড়েছেন করেছেন। প্রায় ৭ কি.মি. দীর্ঘ এ তারুয়া সমুদ্র সৈকতের একপাশে বঙ্গোপসাগর আর অন্যপাশে বিস্তৃর্ণ চারণভূমি, যার শেষ হয়েছে তারুয়া সৈকত সংলগ্ন ম্যানগ্রোভ বনে। হরিণ, বন্য মহিষ, বানর, লাল কাকড়াসহ বিভিন্ন প্রাণির বসবাস এ দ্বীপে। প্রকৃতির নিখাদ নির্জনতা এবং মোহনীয়তা যেসব মানুষকে আন্দোলিত করে, নতুন করে বেঁচে থাকার উদ্দীপনা জোগায় তাঁর সব উপকরণই তারুয়া সমুদ্র সৈকতে দৃশ্যমাণ। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে এ সাজিয়েছে, আপন ভঙ্গিমায়।
তারুয়া দ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। সকালের সোনালী আভায় উদ্ভাসিত সূর্য যখন সাগরের বুক থেকে উঁকি দেয়, তখন তা এক স্বপ্নীল দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়ে মন ও মননশীলতাকে উদ্ভাসিত করে তোলে। আবার যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসে পশ্চিম আকাশ রক্তিম আভায় রাঙা হয়ে ওঠে, তখন যেনো পুূলকিত মনের গহীনে অন্যরকম এক অনুভূতির সঞ্চার হয়।
নামকরণের ইতিহাস :
প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে উঠে সবুজের এ ঢালচর এলাকা। স্থানীয়রা যখন এ এলাকায় মাছ ধরতে আসতেন তখন শত শত তারুয়া নামের এক প্রকার মাছ উঠে আসতো তাদের জালে। ধারনা করা হয়, সে কারণেই এ এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে তারুয়া। যা এখন সবার কাছে তারুয়া সমুদ্র সৈকত নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।
দ্বীপের সন্ধান :
তথ্যমতে, ভোলার বরেণ্য সাংবাদিক এ্যাড. নজরুল হক অনু ২০১০ সালে সংবাদ সংগ্রহের কাজে দক্ষিণের দ্বীপ ঢালচরে যান। সেখান থেকে কৌতূহল বশত: তিনি সাগরপথ পেরিয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের তারুয়া দ্বীপে যান। সেখানে গিয়ে তিনি তারুয়ার তারুণ্যভরা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন। এরপর ২০১১ সালে একঝাঁক গণমাধ্যমকর্মী নিয়ে তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় তিনদিন সেখানে অবস্থানের পর ফিরে এসে দ্বীপটিকে "তারুয়া সমুদ্র সৈকত" নামকরণ আখ্যা দেন। সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় গণমাধ্যমগুলো তারুয়ার সৌন্দর্যের নানা দিক তুলে ধরেন। কালক্রমে দেশের পর্যটনপ্রিয় মানুষের কাছে তারুয়া সমুদ্র সৈকত ব্যাপক পরিচিত লাভ করেন।
অপার সম্ভাবনা :
দ্বীপটি জীববৈচিত্রের এক অপূর্ব ক্ষেত্র। এখানে রয়েছে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি, হরিণ, কাঠ বিড়লী,বন ষাড় এবং শীতকালীন হরেক প্রজাতির অতিথি পাখি। শীতের সকালে দূরদেশ থেকে আসা পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো তারুয়া দ্বীপ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,তারুয়া দ্বীপে স্থায়ী বসতি এখনো উল্লেখযোগ্য হারে গড়ে ওঠেনি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটকদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, যদি যথাযথ প্রচার এবং পর্যটনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়,তাহলে এটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে দিতে পারে। এটি হতে পারে দেশের দ্বিতীয় সেন্ট মার্টিন।
এ দ্বীপে পর্যটন সম্ভাবনা অপরিসীম। পর্যটকদের জন্য ওয়াটার অ্যাডভেঞ্চার, ক্যাম্পিং সুবিধা, এবং পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট গড়ে তোলা হলে এটি কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটার মতো আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রের মতো আকর্ষণীয় স্পটে পরিণত হতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ ও সি-ট্রাক পরিসেবা চালু করা গেলে এখানে ভ্রমণ আরও সহজতর হবে বলে আগতরা মনে করেন। তারুয়া দ্বীপ শুধু সৌন্দর্যের নয়, সম্ভাবনারও এক বিশাল ক্ষেত্র। সাগরের ঢেউ আর সবুজের মাঝে লুকিয়ে থাকা এ দ্বীপ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে তারুয়াকে দেশের পর্যটন মানচিত্রে উজ্জ্বল এক অনন্য স্থানে পরিণত করা সম্ভব।
উপভোগ্য :
তারুয়া সমুদ্র সৈকতে পর্যটকরা একসঙ্গে উপভোগ করতে পারেন বিশাল সমুদ্রের জলরাশি হরেক রকম পরিযায়ী পাখিদের কল-কাকলি, বালুকাময় মরুপথ আর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ছায়াঘন মনকাড়া নিবিড় পরিবেশে সময় কাটানোর সুযোগ, বৈচিত্রময় প্রাণি আর সাগরের উত্তাল গর্জন। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে দ্বীপটিকে সাজিয়ে তুলেছে। বর্তমানে তারুয়া দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ব্যস্তময় জীবনের একঘেয়েমি থেকে অবকাশ যাপনের ইচ্ছায় ঘুরে আসার মতো একটি স্থান তারুয়া সমুদ্র সৈকত। উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন, কেওড়ার শ্বাসমূল, নির্মল বাতাস, সমুদ্রের তাজা মাছ দেখে যেকেউ তারুয়ার প্রেমে পড়ে যাবে। প্রকৃতি প্রেমীরা ঘুরে এলেও তাদের মন পড়ে থাকবে সেখানেই।
তারুয়া সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটক আমিরুল ইসলাম জানান, বৈচিত্রের লীলাভূমি তারুয়া সৈকত। বিশাল সমুদ্র সৈকতে জলরাশিতে বিমুগ্ধকর করে তোলে ঘুরতে আসা পর্যটকদের।
অপর পর্যটক মিল্লাত হোসেন বলেন, ছুটিতে প্রত্যেক শীতেই আমি পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসি তারুয়া দ্বীপে। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। বিচ্ছিন্ন এলাকায় এমন সমুদ্র সৈকত আর বিশাল জলরাশি আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে।
কিভাবে যাবেন তারুয়া :
ঢাকা সদরঘাট থেকে প্রতিদিন একাধিক লঞ্চ চরফ্যাশনের বেতুয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। লঞ্চগুলো ভোরবেলায় ঘাটে পৌঁছায়। লঞ্চে সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ১ হাজার ২শ' থেকে ১ হাজার ৪ শ' ডাবল ২ হাজার ২শ' থেকে ২ হাজার ৪শ' টাকা। ডেক ভাড়া জনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাটে নেমে ইজিবাইকে করে ৩০ টাকা দিয়ে চরফ্যাশন বাজারে যেতে হবে। সেখান থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কচ্ছপিয়া নামক এলাকা পর্যন্ত ব্যাটারীচালিত রিকশা ভাড়া ৮০ টাকা। এসব জায়গায় মোটরসাইকেলও চলে, তবে সেক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হবে দ্বিগুণ।
কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে (ভাড়া ১০০ টাকা) ঢালচর যেতে হবে। যাওয়ার পথে ছোট ছোট নদ নদী পারাপারের সময় বহু সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি পাখিদের কল-কাকলি শুনতে পারবেন।
ঢালচর লঞ্চঘাট থেকে সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার পথ দুটি। এর মধ্যে একটি উপায় হচ্ছে-বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক কষ্ট হবে। কারণ, সেখানে কোনো মসৃণ রাস্তা নেই। বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে কেওড়া বাগান। নতুন কারও পক্ষে হাঁটা ততটা সহজ নয়। অপরদিকে ট্রলার দিয়েও তারুয়া সমুদ্র সৈকতে যেতে পারবেন। এ একই ভ্রমণে পর্যটকরা চর কুকরি-মুকরি ইকোপার্কও ঘুরে আসতে পারবেন।
থাকা-খাওয়া :
এ সমুদ্র সৈকতে থাকার কোনো আবাসিক হোটেল বা ডাকবাংলো নেই। তবে এখানে বেশকিছু বাসায় থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এসব ঘরে জনপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় থাকা যায়। আর খোলা আকাশের নিচে তাবু করে থাকাটা উত্তম। স্থানীয়দের কাছ থেকেও তাবু ভাড়া নিয়ে এখানে থাকা যাবে। ক্যাম্পিংয়ের জন্য আদর্শ জায়গা বলা যেতে পারে এ সমুদ্র সৈকতকে।
এ দ্বীপে দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এছাড়া নদী ও সাগরের নানা প্রজাতির সুস্বাদু মাছ পাওয়া যায়। তবে এখানকার হাঁসের মাংস ভুনা, মহিষের দুধের দই খুবই জনপ্রিয়।
তারুয়া সমুদ্র সৈকত, ম্যানগ্রোভ বন, গো চারণভূমি, স্পীডবোট ও জেলে নৌকায় চড়ে মৎসাভিযান,বনের মহিষ, শেয়ালের হুক্কা-হুয়া কোরাস, হাজারও অতিথি পাখি। তারুয়া সমুদ্র সৈকতে প্রায় ৩০০ ফুট দীর্ঘ, ল্যান্ডিং স্টেশন বানানো হয়েছে যেখানে ট্রলার ও ছোট লঞ্চ ভিড়তে পারবে। এছাড়া সৈকতের বিস্তীর্ণ প্রান্তর-জুড়ে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি ভিন্ন সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে তারুয়া দ্বীপটি।
এখানে কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নেই। তবে স্থানীয়দের সহায়তায় ইচ্ছেমতো রান্না করিয়ে খেতে পারবেন। অথবা নিজেরা রান্না করে খেতে হবে।
পর্যটকদের নির্বিশেষে ভ্রমণের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া আছে। সেখানে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক পুলিশি টহল রাখা হয়েছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা মনে করেন,এখন সময় এসেছে তারুয়া দ্বীপকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার। প্রকৃতির অমূল্য এ রত্নকে পর্যটকদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে পারলে এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করবে।