বাসস
  ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:৪৩

জিমি কার্টার : শান্তি ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট

ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : জিমি কার্টার তার প্রেসিডেন্সি পরবর্তী কর্মজীবনে দু’বার বাংলাদেশ সফর করেছেন, যে সফর ছিল শান্তি ও মানবাধিকারের প্রচারণার নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি মানবজাতির দুর্ভোগ কমানোর প্রচেষ্টার মিশন হিসাবে গ্রহণ। 

কার্টার যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রেসিডেন্ট এবং ১০০ বছর জীবিত ছিলেন এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি তার বেশিরভাগ গুণগ্রাহী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার মিশনের প্রতি ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস ও অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

কিন্তু যারা তার সান্নিধ্যে এসেছেন, তাদের অনেকেই তাকে সামনাসামনি দেখা দিয়েছেন, এমনকি ঘটনাক্রমে তাকে একজন সাধারণ অভিভাবক বা স্কুল শিক্ষকের মতো ব্যক্তিত্ব হিসেবে পেয়েছেন, মনে হয়েছে নতুন করে কিছু শেখাতে বা কারও ছোট্ট ভুলকে আঘাত না করে সংশোধন করতে চান। 

কার্টার সেন্টার এবং ওয়াশিংটন ভিত্তিক ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) এর পক্ষ থেকে ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সফর করেন। এর ফলে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়, এই সময় তারা একটি গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন।

সে সময় বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তার সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ করে দিলে এক তরুণ সাংবাদিক তাকে ‘মিস্টার সাবেক প্রেসিডেন্ট’ সম্বোধন করে একটি প্রশ্ন করেন।

হাসিমুখে কার্টার তার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে তাকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সাবেক প্রেসিডেন্টদেরও ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ বলে ডাকা হয় (সাবেক প্রেসিডেন্ট নয়)।

হোয়াইট হাউস হিস্টোরিকাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, কার্টার একমাত্র মার্কিন রাষ্ট্রপতি যিনি দায়িত্বে থাকাকালীন সানডে স্কুলে (ছুটির দিনের স্কুল) পড়াতেন এবং কার্টার সেন্টারের পরিচালক স্টিভেন হচম্যান ২০১৯ সালে বলেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ২,০০০ এরও বেশি সানডে স্কুলে পাঠ দিয়েছেন। 

টাইম ম্যাগাজিন জানিয়েছে, ২০২০ সালে শারীরিকভাবে আর পারতেন না এমন সময় পর্যন্ত তিনি তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময় সানডে স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।

কার্টার যখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ৫২ বছর, তিনি হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর ৬৬ বছর বেঁচে ছিলেন ও সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক জীবনের বাইরে ছিলেন।

এই ৬৬ বছর তিনি মানবিক ও শান্তির পক্ষে প্রবক্তা হিসেবে দশকের পর দশক কাটিয়েছেন- হ্যাবিট্যাট ফর হিউম্যানিটির সঙ্গে ঘরবাড়ি তৈরি, কয়েক ডজন দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করেছেন।

১৯৮০ সালে বিদায়ী ভাষণে কার্টার বলেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যে আমি আমার দাপ্তরিক দায়িত্ব ছেড়ে দেব, আমাদের গণতন্ত্রে প্রেসিডেন্টের চেয়ে উচ্চতর একমাত্র উপাধি নাগরিক উপাধি আরও একবার গ্রহণ করব।’

কিন্তু পরবর্তী দশকগুলোতে তাকে একজন শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে, মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বৃহত্তর ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। 

কয়েক দশকের বৈরিতার অবসান এবং তাইওয়ানের ব্যয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চীনে তাকে স্মরণ করা হলেও তার এক মেয়াদের প্রেসিডেন্টশিপের বৈশিষ্ট্য ছিল ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের শর্ত যা মধ্য প্রাচ্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা এনেছিল।

বাংলাদেশের সাবেক পেশাদার কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘তবে প্রেসিডেন্ট কার্টার তার সময়কালে দৃশ্যত মানবতার পক্ষে আরও বেশি অবদান রেখেছিলেন। জনগণ এটা বেশি মনে রাখবে।’

আরেক সাবেক কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি তার নৈতিকতার বোধের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন এবং একজন জনসাধারণ বা রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির অন্যান্য মার্কিন প্রেসিডেন্টদের তুলনায় অনেক বেশি উদার ছিলেন।

১৯৮৬ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে একটি গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পের উদ্বোধনের জন্য তার প্রথম বাংলাদেশ সফর।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহকর্মী নোবেল বিজয়ী কার্টারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা স্মরণ করেছেন এবং তাকে ‘বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু’ বলে অভিহিত করেন।

টাইম ম্যাগাজিন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের জন্য একটি প্রশংসায় লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জন্য নৈতিকতা ছিল একটি ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতা যা একটি জাতীয় আহ্বানে পরিণত হয়েছিল।’

লেখক ও প্রেসিডেন্ট কার্টারের প্রধান বক্তৃতা লেখক হিসাবে দায়িত্ব পালন করা হেনড্রিক হার্টজবার্গ লিখেছিলেন, ‘জিমি কার্টার একজন সেইন্ট’, একজন পেশাদার সাংবাদিক'।

হার্টজবার্গ লিখেছিলেন, কার্টার শান্তিতে বিশ্বাস করতেন, যুদ্ধ প্রতিরোধে ও মানবাধিকারে- এই দুটি মূল্যবোধ ছিল মুখ্য, যার মাধ্যমে তিনি তার বৈদেশিক বিষয়গুলো পরিচালনা করতেন, আবার এই মূল্যবোধগুলো ছিল তার ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ববোধের প্রকাশ।