শিরোনাম
নাটোর, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : সেলাই মেশিনে দুই দশক ধরে স্বপ্ন বুনে চলেছেন জোহুরা। তৈরী করেছেন শুধু ব্যবসায়ের ঠিকানাই নয় অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের ঠিকানা। জহুরা’র গল্প শুধু সফলতার নয় জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ারও।
২০০১ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু হয় পথচলা। সম্ভাবনাময় জোহুরাকে পরবর্তীতে আরো দু’ দফায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। একটি ব্লক-বাটিক, অপরটি বিউটিফিকেশন। শুধু প্রশিক্ষণই নয় যুব উন্নয়ন তাকে যুব ঋণ দিয়েছে, দিয়েছে উদ্যোক্তা ঋণ। যুব উন্নয়নের সকল প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে শহরের রাণীভবানী সরকারি মহিলা কলেজের সামনে মহিলা ও শিশুদের পোশাক তৈরী এবং পোশাক বিক্রয় কেন্দ্র ‘আপন ঘর লেডিস টেইলার্স এন্ড শপিং সেন্টার’। অন্য যে কোন টেইলার্স বা শপিং সেন্টার থেকে এটি ব্যতিক্রম। কেন ব্যতিক্রম? সালোয়ার-কামিজগুলো আকর্ষণীয়, তৈরী করা দেওয়া পোশাকের মানটা একটু সুন্দর। এ রহস্য সম্পর্কে জোহুরা জানান, আমি নিজেই মাসে দু’বার ঢাকা যাই, পছন্দ করে পোশাক কিনে নিয়ে আসি। আর তৈরী করা পোশাক কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে তবে তৈরী করি-যা কেউ করে না।
প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটা থেকে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। নামাজ আর কোরআন তেলাওয়াত করে বাড়িতেই শুরু করেন পোশাকের কাপড় কাটার কাজ। কাজ শেষ করে তবেই সকালের চা। এ পেশাদারিত্ব আছে বলেই, হয়তো আছে সফলতা। টেইলরিং শাখায় এখন কাজ করছেন পাঁচজন নারী। কাজের উপরে তাদের পারিশ্রমিক। অনেকের উপার্জন আট হাজার টাকা পর্যন্ত।
টেইলরিং কাজে নিয়োজিত বেবি রাণী জানান, জোহুরা দিদি অনেক ভালো মানুষ। ভালো ব্যবহারে সকলের মন জয় করে নেন। বাবাহারা আমার একমাত্র মেয়েকে স্কুল পেরিয়ে রাণীভবানী সরকারি কলেজে পড়াতে পারছি, দিদি আমাকে কাজ শিখিয়ে এখানে কাজ দিয়েছেন বলে।
স্বামী পরিত্যক্তা শরীফা খাতুনের লাগাতার কাজ করে যাওয়া, এতিম রুহুল আমিন সেলাই কাজ শিখে উপার্জিত অর্থে এসএসসি থেকে মাস্টার্স পাস করে উ”চ পদস্থ কর্মকর্তা হয়ে উঠা, সেলাই কাজে প্রতিবন্ধী কুলসুমের দক্ষ হয়ে উঠাসহ অসহায় জনগোষ্ঠীর দেখা পাওয়া যায় এ সেন্টারে। অসহায় মানুষের আর্তনাদ যেন শুনতে পান জোহুরা। কারন একটা সময় তিনি নিজেই ছিলেন অসহায়। তিন বোন, দুই ভাই আর বাবা-মা মিলে নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী ভাবনীতে ছিলো এক সময় ছিলো সুখের সংসার। যেন চাঁদের হাট। এ চাঁদের আলো ম্লান হয়ে যায়, নবম শ্রেণীতে জোহুরা’র বিয়ে হওয়ার পরে। শিশু বয়সেই জন্ম হয় এক মেয়ের। এভাবেই এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া। কিন্তু স্বামীর অনৈতিক কার্যক্রমে ঐ সংসার রক্ষা করা যায়নি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় জোহুরা এ অকূল পাথারে খোঁজ পান যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রশিক্ষণের। প্রশিক্ষণ শেষে শুরু হয় সেলাই আর সেলাই। শুধু টেইলরিংই নয়, শুরু করেন শপিং সেন্টার। শপিং সেন্টারের আকর্ষণ হয়ে উঠে, রাজশাহী থেকে ২৫ নারীকে দিয়ে হাতের নকশাঁ সেলাই কাজ করা কামিজ আর ওড়না। সেন্টারের পাশে শুরু করেন বিউটি পার্লারের কাজ। এক হাতে গড়া এ বিউটি পার্লার এখন ‘সুমাইয়া বিউটি পার্লার’ নামে পরিচিত, পরিচালনা করছেন নিজের ছোট বোন আয়েশা।
জোহুরা খানম বলেন, শুধু নিজের ব্যবসায় নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার কারনে এ সেন্টারে বিনাপয়সায় সেলাই কাজ শিখিয়েছি অন্তত দেড়শ’ ব্যক্তিকে। এসব নারীদের অনেকেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। পাশাপাশি, একটি এনজিও’র আয়োজনে ৪৫জন নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এরমধ্যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৩১জনকে জেলা প্রশাসন বিনামূল্যে দিয়েছে সেলাই মেশিন। এসব নারীদের অনেকেই এখন স্বাবলম্বী।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর নাটোর সদর উপজেলার সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এফ এ ওয়াশী বাপী বলেন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে সফলতা পেয়েছেন অনেকেই। তবে জোহুরা খানম একটি দৃষ্টান্ত।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর নাটোর জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক কে এম আব্দুল মতিন বলেন, সফল উদ্যোক্তা জোহুরা খানম শুধু সফলই হননি, অন্যদের স্বাবলম্বী করতে সতত সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তাঁর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ‘আপন ঘর’ যেন বাতিঘর। আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।