ঈদের শাড়িতে নতুনত্ব আর বৈচিত্র্য আনতে ব্যস্ত টাঙ্গাইলের তাঁতীরা

বাসস
প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৫, ১৪:০৮ আপডেট: : ২৪ মার্চ ২০২৫, ১৪:২৭
বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি ও সারাদেশে সরবরাহ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন টাঙ্গালের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পের কারিগরগণ। ছবি : বাসস

।। মহিউদ্দিন সুমন ।।

টাঙ্গাইল, ২৪ মার্চ ২০২৫ (বাসস) : যে কোনো অনুষ্ঠানেই বাঙালী নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। তার মধ্যে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ি হলে তো কথাই নেই। নিজের জন্য কিংবা প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার জন্য টাঙ্গাইল শাড়ির জুরি নেই। আর মাত্র এক সপ্তাহ পরই পবিত্র ঈদুল ফিতর। প্রতি বছরের মত এবার ঈদেও বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি ও সারাদেশে সরবরাহ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতীরা। ঈদ উপলক্ষে শাড়িতে এসেছে বৈচিত্র্য এবং নতুনত্ব। 

টাঙ্গাইলের বিখ্যাত তাঁত পল্লী পাথরাইল, চন্ডি, বাজিতপুর ও পুটিয়াজানির মত অনেক গ্রামেই এখন তাঁতীদের ব্যস্ত সময় কাটছে। সুতি জামদানী, সফ্ট সিল্ক, ধানসিঁড়ি, বালুচুরি, গ্যাসসিল্ক, স্বর্নকাতান, দোতারি, চোষা ও রেশম শাড়ীর মত বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করে সরবরাহ করা হচ্ছে সারাদেশে। 

জেলার দেলদুয়ারের তাঁত শিল্প এলাকায় ঢুকতেই শোনা গেল তাঁতের খটখটি শব্দ। দিন রাত চলছে  কাপড়  বোনার প্রাতিযোগিতা। কত দ্রুত এবং কত বেশি মানসম্মত শাড়ি তৈরি করা যায় ঈদের আগেই সেই চেষ্টায় ব্যস্ত সবাই।   

জানা যায়, ঈদে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসময় জেলার প্রায় ১০ হাজার তাঁতী কাপড় বুননের কাজে ব্যস্ত রয়েছে। ঈদের কয়দিন পরেই বাংলা নববর্ষ। তাই সব মিলেয়ে দম ফেলার ফুসরত নেই তাঁত শ্রমিকদের। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সমান তালে কাজ করছেন এসব কারখানায়। তবে মজুরি কম হওয়ায় হতাশ তাঁতীরা ।

সরেজমিনে তাঁত শিল্প এলাকা পরিদর্শন করে জানা যায়, রমজান মাসের শুরু থেকেই টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পগুলো সরগরম হয়ে উঠেছে। তাদের উৎপাদিত কাপড় ব্যপক ভাবে দেশের মার্কেটগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে। আর তাই হরেক রকম ডিজাইনের নিজেদের পছন্দের কাপড়টি কিনতে শোরুমগুলোতে ক্রেতাদের কমতি নেই। উৎপাদন বেশি ও অন্যান্য মাসের চেয়ে একটু বেশি লাভবান হওয়ার আশায় তাঁত মালিকরা বাড়তি মজুরি নিয়ে হাজির হয়েছেন শ্রমিকদের সামনে। আর শ্রমিকরাও বোনাসের আশায় দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। 

ঈদ উপলক্ষে টাঙ্গাইল পৌর এলাকার বাজিতপুর ও করটিয়া সাপ্তাহিক হাটে তাঁতজাত পণ্য ক্রয়ের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা ভিড় জমান। এ সব হাটে পাইকার ও খুচরা ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। সরাসরি তাঁতীদের কাছ থেকে তারা নানা ডিজাইনের কাপড় কিনছেন। 

তাঁত শ্রমিক ইকবাল হোসেন বাসসকে বলেন, ‘ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। এ কারণে বাড়তি কিছু মজুরি পাওয়া যাচ্ছে। আগে সপ্তাহে তিনটি শাড়ি তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু এখন সপ্তাহে চারটি শাড়ি তৈরি করছি। মজুরি কম থাকায়, নতুন করে কেউ কাজে আসতে চায় না। ধান কাটতে একদিনে মজুরি পাওযা যায় ৮০০ টাকা। তবুও ধান কাটার শ্রমিকের সমান মজুরি পাওয়া যায় না। আমাদের মজুরি বাড়ানো হলে পরিবার নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে পারতাম।’

তাঁত শ্রমিক নারায়ন চন্দ্র বলেন, ‘২৩ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত আছি। ঈদ উপলক্ষে বালুচুরি শাড়ি তৈরি করছি। প্রতি পিস শাড়িতে ৬০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। সপ্তাহে ৫টি শাড়ি তৈরি করছি। এতে আমাদের পোষায় না। কম মজুরি দিয়ে সংসার চালানো দুরূহ হয়ে উঠেছে। আগের মতো জমজমাট নেই তাঁতপল্লী। তবুও বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছি আমরা।’

করটিয়া হাটে কথা হয় বরিশালের শাড়ি ব্যবসায়ী রাকিবুল হাসানের সাথে। তিনি বলেন, ‘টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির জন্য করটিয়া হাটের সুনাম রয়েছে। করটিয়া হাটে অনেক রকমের ডিজাইনের কাপড় সরাসরি তাঁতীদের কাছ থেকে সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। এ হাট থেকে পাইকারী দরে কাপড় কিনে নিজ জেলায় বিক্রী করবো। 
জানা যায়, করটিয়া হাট থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার শাড়ি ব্যবসায়ীরা শাড়ি কিনে নিয়ে যান। সেখানে তারা খুচরা বিক্রি করে থাকেন। তবে এবার সুতার দাম বেশি হওয়ায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির দামও একটু বেশি। টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীতেও দেশের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে ক্রেতারা শাড়ি কিনতে ভিড় করছেন। ব্যস্ত সময় পার করছেন টাঙ্গাইল জেলা শহরের শোরুমগুলোর বিক্রেতারাও। স্বাচ্ছন্দ্যে পছন্দের শাড়ি কিনছেন সবাই।
করটিয়া হাটে শাড়ি কিনতে আসা ঝিনাইদহের শাড়ি ব্যবসায়ী বাদশা মিঞা বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে বাঙালী নারীদের কাছে টাঙ্গাইলের তাঁতে শাড়ির কদর বেশি । তাই করটিয়া হাট থেকে পাইকারি দামে শাড়ি কিনে নিয়ে নিজ এলাকায় বিক্রি করবো।’ 

রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে টাঙ্গাইলের পাথরাইল তাঁত শিল্প এলাকায় খুচরা কাপড় কিনতে এসেছিলেন রেজিয়া বেগম। তিনি জানান, টাঙ্গাইলের শাড়ীর সুনাম দেশব্যাপী। তিনি নিজেও এ শাড়ী পছন্দ করেন। তাই সরাসরি তাঁতীদের কাছ থেকে কাপড় কেনার জন্য টাঙ্গাইলের পাথরাইলে এসেছেন। ঢাকার চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে ও পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি কিনতে পেরে তিনি খুব খুশী। 

শাড়ি ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, সবনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকার পর্যন্ত দামে  শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। পাওয়ার লুমের কারণে হ্যান্ডলুমের তৈরি শাড়ি কম চলে। হ্যান্ডলুমের শাড়ির দামও বেশি। এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখ পাশাপাশি হওয়ায় বিক্রি ভালো হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

শাড়ি ডিজাইনার ও বিশিষ্ট শাড়ি ব্যবসায়ী নীল কমল বসাক বাসসকে বলেন, আসন্ন ঈদ উপলক্ষে টাঙ্গাইলের শাড়ির ব্যবসা এবার গত বছরের তুলনায় ভাল। ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবার ঈদেও টাঙ্গাইল শাড়িতে এসেছে বাহারি ডিজাইন আর নতুনত্ব। এ বছর সফ্ট সিল্ক ও সুতি শাড়ির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ঈদকে কেন্দ্র করে নতুন ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে আবহাওয়া অনুযায়ী ‘ভেজিটেবল ডাই’ নামের নতুন শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এবারের ঈদে ভেজিটেবল ডাই ভাল বিক্রি হচ্ছে। আশা করছি পহেলা বৈশাখ কাছাকাছি হওয়ায় বিপুল পরিমাণ শাড়ি বিক্রি হবে। 

টাঙ্গাইল জেলা শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বাসসকে বলেন, ঈদ উপলক্ষে এবার বিভিন্ন ডিজাইনের তাঁতের শাড়ি তৈরী হয়েছে। এদের মধ্যে সিল্ক, বিখ্যাত জামদানি, সফ্ট সিল্ক, দোতারি, রেশম, তশর ইত্যাদি। সিল্ক শাড়ী সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে ১৪ হাজার, নেট জুট সাড়ে ১০ হাজার, বাহার শাড়ী সাড়ে ১৬ হাজার, কটন জুট আড়াই হাজার এবং টিস্যু সিল্ক সাড়ে ৪ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবার ঈদে শাড়ি ব্যবসায় ব্যবসায়ীরা লাভবান হতে পারবেন। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ট্রাম্পের ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের’ নিন্দা জানিয়ে চিঠি 
মেহেরপুরে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত 
চট্টগ্রামে জব্বারের বলীখেলার ১১৬তম আসর বসছে ২৫ এপ্রিল
দোহায় ৪ নারী ক্রীড়াবিদকে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রধান উপদেষ্টা
সুনামগঞ্জে টাস্কফোর্সের অভিযানে ভারতীয় পণ্য জব্দ
লিড নিয়ে চা-বিরতিতে বাংলাদেশ
বাংলাদেশকে ৬২ কোটি ৬০ লক্ষ মার্কিন ডলার ঋণ দিবে কোরিয়া
বায়ার্নের অনুশীলনে ফিরেছেন নয়্যার ও উপামেকানো
ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে ডিএমপি’র ১৬২০ মামলা
সাংবাদিকের জন্য ঝুঁকি ভাতা, বিমা ও পেনশন চালুর সুপারিশ
১০