আড়াই লাখ কৃষক ভুট্টা চাষে জড়িত

মানসম্পন্ন ভুট্টা উৎপাদনের শীর্ষে চুয়াডাঙ্গা

বাসস
প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৫, ১৬:৫৫
ছবি : বাসস

// বিপুল আশরাফ //

চুয়াডাঙ্গা, ২৭ মার্চ ২০২৫ (বাসস) : দেশে মানসম্পন্ন ভুট্টা উৎপাদনের শীর্ষে চুয়াডাঙ্গা। চলতি বছর জেলার মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় অর্ধেক জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। এই চাষের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত আছেন আড়াই লাখ কৃষক। ফলে, জেলার প্রধান অর্থকরী ফসলের স্থান দখল করেছে ভুট্টা।  

কয়েক বছর ধরে ভুট্টা চাষ লাভজনক হওয়ায় কৃষকের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে। মানসম্মত ভুট্টা উৎপাদন হওয়ায় গড়ে উঠেছে ফিড মিলসহ বড় বড় কোম্পানির ক্রয় ও বিক্রয় কেন্দ্র। কয়েক দিনের মধ্যে কৃষকের কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে উঠবে। এবারও লাভবান হবেন এমন আশায় বুক বাঁধছেন কৃষক। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৯৪ হাজার ২’শ ২২ হেক্টর। এ বছর ৪৭ হাজার ৯ শ ৫৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। যা থেকে ৫ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি নির্ভরশীল জেলা। এ জেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। এক সময় এখানকার কৃষকরা ধান, পাট, আখ, ডাল ও তৈল জাতীয় শস্য আবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃষকরা তাদের কৃষি পণ্য পরিবর্তন করেছেন। বেছে নিয়েছেন ভুট্টা।  দিন দিন ভুট্টার আবাদ বেড়ে যাওয়ায় ভুট্টা এ জেলার প্রধান অর্থকরী ফসলের স্থান দখল করে নিয়েছে। 

ভুট্টা চাষের মৌসুম নভেম্বর থেকে এপ্রিল। নভেম্বর মাসে বীজ বপন করা হয়। এপ্রিল মাসে ফসল ঘরে উঠতে শুরু করে। অনেকে আবার আগে বা পরে ভুট্টা চাষ করে। তবে সময়মতো চাষ না করলে উৎপাদন কম বেশি হয়। ভরা মৌসুমে যারা আবাদ করেন তারা বিঘা প্রতি প্রায় ৪০ মণ ভুট্টা পেয়ে থাকেন। বিঘা প্রতি খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতি মণ ভুট্টা বিক্রয় হচ্ছে ১১৫০ টাকা দরে। তাতে খরচ বাদ দিয়েও অনেকটাই লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।

জানা যায়, এই এলাকার মাটি ভুট্টা চাষের উপযোগী। এ কারণে অন্যান্য অঞ্চলে একর প্রতি যে পরিমাণ ভুট্টার ফলন হয় তার থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলার ভুট্টার ফলন অনেক বেশি। এ জেলায় উৎপাদিত ভুট্টা অত্যন্ত মানসম্পন্ন । ফলে লোকসানের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এ কারণে চাষিরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। 

পাঁচ কমলাপুর গ্রামের চাষি আব্দুল হান্নান বাসসকে বলেন, ‘দিন রাত পরিশ্রম করে আমরা বিভিন্ন ফসলের আবাদ করি। আমাদের অধিকাংশ কৃষক বর্গাচাষি। পরের জমি লিজ নিয়ে চাষ করতে হয়। এখানে ফসলের বিচার (নির্বাচন) ঠিক না হলে লোকসানে পড়তে হয়। গত কয়েক বছর ধরে এই এলাকার কৃষকরা ভুট্টা চাষ করে লাভবান হয়েছে। তাই আমিও ভুট্টাকেই প্রধান আবাদ হিসাবে বেছে নিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘আমি যেমন লাভবান হয়েছি, ঠিক তেমনই অনেকেই ভুট্টার আবাদ করে গত কয়েক বছরে ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সম্পদ করেছে। খরচের তুলনায় উৎপাদন বেশি, লাভের ভরসাও তাই বেশি থাকে।’

সদর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের আসাদুল বলেন, ‘এবছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভুট্টার মোচা বড় হয়েছে এবং দানাদার হয়েছে। তাতে ফলন ভালো হবে বলে আমার বিশ্বাস। যদিও প্রতি বছরই সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়, তারপরও এতে লোকসান নেই।’ 

আলমডাঙ্গা উপজেলার ঘোলদাড়ী গ্রামের কৃষক মামুন বলেন, ‘ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার হওয়ায় এর থেকে লাভ বেশি হয়। গাছ এবং মোচা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও গ্রামের অধিকাংশ কৃষক গরু পালন করে। ভুট্টার পাতা গোখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে।’

আলমডাঙ্গার পাইকপাড়া  গ্রামের ভুট্টা চাষি শরিফুল  ইসলাম জানান, এ বছর তিনি ৮ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। ধানের আবাদের চেয়ে ভূট্টার আবাদ অনেক লাভজনক হওয়ায় তার দেখাদেখি এখন ওই এলাকার অনেক চাষিই ভূট্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিঘা প্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হলেও ৩৮ থেকে ৪০ মণ পর্যন্ত ভুট্টা উৎপাদন সম্ভব। ভুট্টা চাষের পর ভুট্টার শুকনো গাছ ও ভুট্টা মাড়াইয়ের পর তা জ্বালানি হিসেবে বাজারে বিক্রি করে বিঘা প্রতি ২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। 

দর্শনার শ্যামপুর গ্রামের কৃষক খলিল মিয়া জানান, গত বছর ভুট্টা বিক্রি করে লাভের মুখ দেখা গেছে। গত বছর ভুট্টার দাম ছিল মণ প্রতি ৯শ টাকা। তবে এবার এলাকায় ভুট্টা বেশি চাষ হওয়ায় দাম নিয়ে চাষিরা শঙ্কায় রয়েছেন।

ভুট্টা চাষ বেশি হওয়ায় চুয়াডাঙ্গাতেই ভুট্টার বাজার তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য চাষ, লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগির ফার্ম ও গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের জন্য এখানেই ভুট্টার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চুয়াডাঙ্গায় সিপি বাংলাদেশ ও নারিশ কোম্পানির ফিড মিল গড়ে উঠেছে। এছাড়াও দেশের বৃহত্তর ভুট্টা ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান আফতাব, প্যারাগন, এসিআই, গোদরেজসহ বিভিন্ন কোম্পানি এখান থেকে ভুট্টা ক্রয় করে থাকে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিক লাভজনক হওয়ায় ভুট্টা এখন এলাকার প্রধান অর্থকরী ফসল হয়ে উঠেছে। 

বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে নতুন ভুট্টা উঠতে শুরু করেছে। ভুট্টা কেনাবেচায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আড়তদার ও ফড়িয়ারা। বাজারে প্রতি মণ ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে ১১৪০/১১৬০ টাকা দরে। 

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ভুট্টা উৎপাদনে দেশের শীর্ষ তিন জেলার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা একটি। ভুট্টা চাষে চাষিরা লাভবান হওয়ায় গত বছরের চেয়ে এ বছর  ভুট্টা আবাদ বেড়েছে। অল্প পুঁজিতে অধিক লাভবান হওয়ায় ভুট্টা আবাদের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন কৃষকরা। ভুট্টা চাষে উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার করায় ভুট্টার ফলনও বেশি পাওয়া যায়। চুয়াডাঙ্গায় প্যাসিফিক-৯৮১, পাইওনিয়ার ভি-৯২ ও ৯৬, এলিট, মিরাক্কেল, উত্তরণ, সানশাইন, সিপি এবং পালোয়ান এ-৯ জাতের ভুট্টা বেশি চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে প্যাসিফিক-৯৮১, পাইওনিয়ার ভি-৯২ ও ৯৬ এবং এলিট জাতের ভুট্টা।  

সূত্র জানায়, এ বছর জেলায় ৪৭ হাজার ৯ শ ৫৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় চাষ হয়েছে ১৫ হাজার ২শ ১২ হেক্টর, দামুড়হুদায় ১২ হাজার ৫শ হেক্টর, আলমডাঙ্গায় ১৪ হাজার ১শ ২৩ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৬ হাজার ১ শ ২০ হেক্টর।  গত বছরের থেকে এ বছর ৫ শত হেক্টর বেশি জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে।   

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান বলেন, এবার দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা ভুট্টা চাষে তিন নম্বরে রয়েছে। তবে ফলনের শীর্ষে চুয়াডাঙ্গার ভুট্টা। এটি চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসীর জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতিবারের মত এবারও ভুট্টার ভাল ফলন পাওয়া যাবে। স্থানীয়

চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভের কথা চিন্তা করেই ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়েছে। উন্নতমানের বীজ সরবরাহ এবং উৎপাদিত ফসলের ভালো দাম এর অন্যতম কারণ।

এ ছাড়াও উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষিদের চাষে আগ্রহ বৃদ্ধি ও দক্ষ করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
মহাখালী পেট্রোল পাম্পে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৫ ইউনিট
আরএমপির তিন থানায় নতুন ওসি 
নওগাঁয় পানিতে ডুবে কিশোরের মৃত্যু
অব্যাহত সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত 
লজিস্টিকস খাতে দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে এনএসডিএ’র স্টেকহোল্ডার কনসালটেশন
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত
পরিবেশ অধিদপ্তরের একাধিক অভিযানে জরিমানা ও সতর্কবার্তা
হাওড় অঞ্চলের প্রকল্পগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন করার তাগিদ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টার
নির্বাচন কমিশন যথাযথভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে : নজরুল ইসলাম খান
মুন্সীগঞ্জে যৌথ অভিযানে অবৈধ কসমেটিক পণ্য জব্দ
১০