সিলেট, ১২ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : ডিজিটাল সিলেট সিটি নামে পাইলট প্রকল্প নিয়ে সিলেটে বিনামূল্যে ওয়াইফাই ইন্টারনেট সুবিধা দেয়ার স্বপ্ন দেখায় আইসিটি মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের পর থেকে এই সেবাটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।
২০১৭ সালে স্মার্ট নগর গড়তে ৩০ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিজিটাল সিলেট সিটি নামে পাইলট প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। মেয়াদ ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত নেয়া হয়।
প্রকল্পের আওতায় বিনামূল্যে ওয়াইফাই হটস্পট, অপরাধকারী শনাক্তকরণে ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) ক্যামেরা স্থাপনসহ ১১টি কম্পোনেন্ট বেছে নেয়া হয়। পরে ৮টি বিষয় বাদ দিয়ে দুটি আইপি ক্যামেরা ও ওয়াইফাই সেবা দুটি বাস্তবায়ন করা হয়।
২০২০ সালের মার্চে ঢাকঢোল বাজিয়ে বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবাটি চালু করা হয়। এর মাধ্যমে নগরের ৬২টি পয়েন্টে ১২৬টি এক্সেক পয়েন্টে নগরবাসী কিংবা আগত পর্যটকদের জন্য এই সুবিধার কথা জানায় কর্তৃপক্ষ। একেক পয়েন্টে একসঙ্গে ৫০০ ব্যবহারকারী সর্বোচ্চ ১০ এমবিপিএস গতিতে ইন্টারনেট সুবিধা পাবেন বলেও জানান প্রকল্প কর্মকর্তারা।
২০২১ সালের ২১ মার্চ এসব ওয়াইফাই হটস্পট সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে বিসিসি। প্রথম থেকেই এসব সংযোগে ধীরগতির ইন্টারনেট বা প্রায়ই সংযোগ না পাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিয়েছিল। একই বছর থেকে সেবাটি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, আর চালু হয়নি।
সিলেট নগরের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত এলাকায় চৌহাট্টা পয়েন্টে ওয়াইফাই ডিভাইস লাগানো হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন শহিদ মিনারে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। অথচ, সংস্কৃতি কর্মীরা বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবা পাননি কখনো।
সংস্কৃতিকর্মী আল আমিন রিফাত জানান, গত সাত বছর ধরে শহিদ মিনারে অনুষ্ঠান করতে আসা হয়। ২০২০ সালের দিকে ওয়াইফাই সেবার ব্যাপারে জানার পর একদিন সংযোগ পেয়েছিলাম। দু’মিনিট পরেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর অনেকবার চেষ্টা করেছি। আর কখনো ওয়াইফাই সেবা মিলেনি।
বন্দরবাজার, টিলাগড় পয়েন্ট, রিকাবীবাজার কবি নজরুল অডিটরিয়ামসহ ব্যস্ততম বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ী, শিক্ষক, কলেজ শিক্ষার্থী, পথচারীসহ নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়।
নগরের শিবগঞ্জ পয়েন্টের পাশে সিলমার্ক টাওয়ারে আইটি কর্নার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক রায়হানুল ইসলাম। তিনি জানান, ওয়াইফাই সেবাটি চালু আছে কি না জানতে তিনি দু-একমাস পর পর মুঠোফোনে সংযোগ পাওয়ার চেষ্টা করেন। একবারও সেটা সম্ভব হয়নি।
ওয়াইফাই সেবাটি বন্ধ থাকার কথাটি স্বীকার করে প্রকল্প পরিচালক মাহিদুর রহমান খান। তিনি বাসসকে বলেন, ‘ঠিকমতো সবকিছু রেডি করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দিয়েছি। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ কোম্পানী এক বছর ওয়াইফাই সুবিধা দিয়েছে। এখন সেবাটি চালু রাখার দায়িত্ব সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক)। এখন সেই প্রতিষ্ঠান সেবা অব্যাহত রাখবে কি না সেই সিদ্ধান্ত তারা নেবে।’
প্রকল্পের ওয়াইফাই কম্পোনেন্টটি চালু করতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোট ব্যয় ছিল ৩০ কোটি টাকা। তবে কেবল ওয়াইফাই চালু করতে কত টাকা খরচ হয়েছে সেটি এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না।’
সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে—এটি ছিল সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত উদ্যোগ। প্রকল্প পরিকল্পনার আগে সিটির সঙ্গে কেউ কথা বলেনি। হঠাৎ বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা দায়িত্ব নিয়েছেন। পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য বাজেট চেয়েও মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া যায়নি। দক্ষ জনবলও নেই তাদের।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বাসসকে বলেন, বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবার দায়িত্ব আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু এটা চালাতে যে খরচ দরকার তা পাওয়া যায়নি। তাই এখন নগরবাসী বিনামূল্যে ওয়াইফাই ব্যবহার করতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবা চালু করতে প্রতিমাসে ৭ লাখ টাকা দরকার। বছরে দরকার প্রায় এক কোটি টাকা। তৎকালীন মেয়র এই প্রকল্প পরিচালনায় অর্থ বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু বরাদ্দ মিলেনি।
সেবাটি চালু করার কোনো পকিল্পনা তাদের নেই বলেও জানান এই কর্মকর্তারা। তিনি বলেন, এতদিনে প্রায় সবগুলো ডিভাইস নষ্ট হয়ে গেছে। চালু করতে গেলে অনেক টাকা খরচ লাগবে, রক্ষণাবেক্ষণ করার জনবলও নেই। তাই আমরা এটা নিয়ে ভাবছি না।
সিটি করপোরেশন জানায়, একই প্রকল্পের অধীনে সিলেট নগরে ১১০টি আইপি ক্যামেরা স্থাপনের পর সেটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এরই মধ্যে ক্যামেরাগুলোর অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। নগরবাসীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ক্যামেরাগুলো মেরামত ও পুনঃস্থাপনে দুই দফা টেন্ডার করে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে করেছে সিসি করপোরেশন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি সিলেটের সাবেক সভাপতি এনামুল কুদ্দুস চৌধুরী বলেন, এই ধরনের প্রকল্প মূলত লুটপাটের জন্য। সিলেটকে প্রথম ডিজিটাল সিটি করার যেভাবে প্রচার হয়েছিল বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সেগুলো কেবল আবর্জনা। অতীতে সিলেটবাসীকে এভাবে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বাস্তবমুখী প্রকল্প গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।