ময়মনসিংহে কর্মজীবী মায়েদের ভরসা শিশুযত্ন কেন্দ্র

বাসস
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৫, ১৪:১৫
জেলার শিশুযত্ন কেন্দ্রগুলোতে শিশুদের জন্য তৈরি করা হয়েছে এক রঙিন ও আনন্দময় পরিবেশ। ছবি: বাসস

।। মো. আব্দুল কাইয়ুম।।

ময়মনসিংহ, ১২ আগস্ট, ২০২৫, (বাসস) : মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাস্তবায়িত সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্র (আইসিবিসি) প্রকল্প ময়মনসিংহের শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশে এক বিপ্লব ঘটিয়েছে। 

২ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ, সঠিক যত্ন ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করে এই প্রকল্প কর্মজীবী পরিবারের জন্য বড় স্বস্তি হয়ে উঠেছে। কর্মজীবী মা-বাবা, বিশেষ করে নারীদের জন্য প্রকল্পটি শুধু একটি আশ্রয় নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার এক কার্যকর উদ্যোগ।

গবেষণা অনুযায়ী, জীবনের প্রথম পাঁচ বছর শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ের সঠিক পরিচর্যা শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা, সামাজিক আচরণ এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে। আইসিবিসি প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হলো সেই প্রারম্ভিক বিকাশ নিশ্চিত করা। প্রকল্পটির আওতায় ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা শিশুযত্ন কেন্দ্রগুলো স্থানীয় অভিভাবক ও শিশুদের জীবনে এনেছে এক নতুন মাত্রা।

জেলার শিশুযত্ন কেন্দ্রগুলোতে শিশুদের জন্য তৈরি করা হয়েছে এক রঙিন ও আনন্দময় পরিবেশ। “আপন ভূবন, রঙের ভূবন, গল্পের ভূবন, স্বপ্নের ভূবন” প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুদের কল্পনা, সৃজনশীলতা এবং দলগত সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে খেলার মাধ্যমে গণিত, বর্ণমালা এবং গল্প শোনার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে।

সরেজমিনে জেলার ত্রিশালের ধলাইমন হাজী বাড়ি শিশুযত্ন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট শিশুরা কেয়ারগীভারের তত্ত্বাবধানে বর্ণমালা শিখছে, খেলাধুলা করছে এবং হাসিখুশি পরিবেশে দিন কাটাচ্ছে। কেয়ারগীভাররা শিশুদের হাতে-কলমে শিখতে উৎসাহিত করছেন। বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, প্রতিটি শিশু নিজের টিফিন বক্সে আনা খাবার নিজে বসে খাচ্ছে। এতে তাদের আত্মনির্ভরশীলতা ও পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে।

মা সুমি আক্তার জানান, ‘আমার আড়াই বছর বয়সের ছেলে ওমর ফারুককে শিশুযত্ন কেন্দ্রে ভর্তি করেছি। এই সেন্টারে ভর্তির মাত্র ছয় মাসের মধ্যে আমার ছেলে স্পষ্টভাবে কথা বলা শিখেছে। এর আগে সে খুব চুপচাপ ছিল। কিন্তু এখন সহপাঠীদের সাথে মেলামেশা করে খেলছে, শিখছে। আমি নিশ্চিন্তে কাজে মনোযোগ দিতে পারি, কারণ আমি  জানি আমার সন্তান নিরাপদ স্থানে আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো লাগছে, আমার ছেলে মোবাইলের প্রতি আসক্ত নয়। এখানে শরীরচর্চার মাধ্যমে তার শারীরিক বিকাশ হচ্ছে। দুপুরে বাসায় ফেরার পর আমাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়। আমি মনে করি, শিশুযত্ন কেন্দ্রটি আমার সন্তানের জীবনের জন্য বড় সহায়ক।’

আরেক অভিভাবক সাবিহা আক্তার বলেন, ‘আমার ৩ বছর বয়সী মেয়ে এখন পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বাসায় ফিরে সে খেলার ছলে পড়ার অভ্যাস করছে। প্রতিবেশী শিশুরা যখন অলস সময় কাটায়, আমার মেয়ে তখন বই হাতে বসে যায়। তার আচরণও অনেক উন্নত হয়েছে।’

শিশুযত্ন কেন্দ্রের প্রাণশক্তি হলো কেয়ারগীভাররা। ধলাইমন হাজী বাড়ির কেয়ারগীভার রত্না আক্তার বলেন, ‘শিশুদের সঙ্গে প্রতিদিন কাজ করতে গিয়ে আমি তাদের মনের কথা বুঝতে পারি। তাদের সুখ-দুঃখ আমার নিজের পরিবারের মতো মনে হয়। প্রতি মাসে অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন করি, যেখানে আমরা অভিভাবকদের সন্তানদের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাই এবং ঘরে কিভাবে শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটানো যায় তা নিয়ে পরামর্শ দিই।’

ত্রিশালের ডগুলিয়া পনো মাস্টারের বাড়ির কেয়ারগীভার ঝর্ণা আক্তার বলেন, ‘২৫ জন শিশুর হাসি আমার দিনের শক্তি। যখন দেখি, একটি শিশু কান্না থেকে হাসিতে ফিরছে কিংবা খেলাধুলার মাধ্যমে গণিত শিখছে, তখন মনে হয় এরা সবাই আমার নিজের সন্তান।’

কেন্দ্রের তিন বছর বয়সী শিক্ষার্থী আদিতা আফরোজ সাবা বলে, ‘এখানে আসতে আমার খুব ভালো লাগে। খালামনিরা আমাদের অনেক আদর করে। আমরা খেলি, পড়ি, আর নিজের খাবার নিজে খাই।’

ত্রিশালের ডগুলিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী শরীফ হোসেন বলেন, ‘সকালবেলা আমার স্ত্রী ছেলেকে সেন্টারে দিয়ে যায়, দুপুরে দাদি তাকে নিয়ে আসে। আমার ছেলে এত আনন্দে থাকে যে, কখনও কখনও বাড়ি ফিরতেও চায় না।’

স্থানীয় চা ব্যবসায়ী স্বপন মিয়া জানান, ‘আমার ছেলে সেন্টারে থাকার সময় আমি নিশ্চিন্তে দোকানে বসতে পারি। এই সেন্টার আমাদের জীবন-জীবিকার বড় সহায়ক।’

এদিকে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রচুর শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। আইসিবিসি প্রকল্প এ ঝুঁকি কমাতেও শিশুদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে। প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল কাদের জানান, “প্রতি বছর ময়মনসিংহে ৭৫০০ শিশুকে সাঁতার শেখানোর লক্ষ্য রয়েছে। ইতোমধ্যে ৫০০০ শিশু সাঁতার শিখেছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সময়ে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আমাদের সাঁতার প্রশিক্ষণ সেই ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিশুযত্ন কেন্দ্র কর্মজীবী নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করছে। এর ফলে পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়ছে, পাশাপাশি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’

প্রকল্পের সহযোগী সংস্থা সিনার্গসের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর রেজওয়ান হক খান বলেন, ‘শিশুরা সেন্টারে নিরাপদে থাকায় অভিভাবকরা মানসিক প্রশান্তি পান এবং তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ে।  বিশেষ করে এই প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মজীবী নারীরা নিশ্চিন্তে তাদের কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে পারছেন। ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।’

তবে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় অভিভাবক ও কেয়ারগীভাররা মনে করেন, এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে শিশুদের মানসিক বিকাশে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।  কেয়ারগীভার রত্না আক্তার বলেন, “শিশুদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মায়ের  মতো। প্রকল্প বন্ধ হলে শুধু শিশুরা নয়, আমরাও ভীষণভাবে আঘাত পাব।’
চ্যানেল আই এর প্রধান বার্তা সম্পাদক মীর মাসরুর জামান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, প্রাথমিক বয়সে শিক্ষা ও যত্নের উপর বিনিয়োগ একটি দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের শক্তিশালী হাতিয়ার। তাই এই প্রকল্পকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যুক্ত করা সময়ের দাবি।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
যুব দিবসে সুনামগঞ্জে বিতর্ক প্রতিযোগিতা
খুলনার ডুমুরিয়ায় যাত্রীবাহী বাস থেকে মাদক উদ্ধার, আটক ২
উপহাস উপেক্ষা করে সফল বগুড়ার রেজওয়ানুল
জিএম কাদের-মাহমুদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার
খুলনায় শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা
চানখাঁরপুলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ
দিনাজপুরের মৎস্য খামারিদের ভাগ্য বদলে দিচ্ছে দেশি টেংরার চাষ
বোর্নমাউথ থেকে ইউক্রেনিয়ান ডিফেন্ডারকে দলে নিল পিএসজি
জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধে সংশোধিত আইনে কঠোর বিধান রাখা হবে: শ্রম উপদেষ্টা
২০২৫-২৬ অর্থবছরে কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৯ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
১০