দিলরুবা খাতুন
মেহেরপুর, ২৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): দুই মেয়ের ভেড়ার মাংস খাওয়ার আগ্রহ থেকে গাড়ল পালন। সেখান থেকে একটি খামারই গড়েছেন মেহেরপুরের আনোরুল ইসলাম (আনার) ও লাভলী খাতুন দম্পতি। তারাই আবার গাড়লের সঙ্গে দুম্বার সংকর ঘটিয়ে নতুন একটি জাত উদ্ভাবন করেছেন। নতুন জাতের এই দুম্বা উদ্ভাবন করে এ দম্পতি ইতোমধ্যে সাড়া ফেলেছেন। স্থানীয়ভাবে খামারিরা এটিকে ‘মেহেরী সংকর’ নামে ডাকছে। স্থানীয় আবহাওয়ায় টিকে থাকতে সক্ষম, দ্রুত বেড়ে ওঠা ও মাংস উৎপাদনেও লাভজনক এ দুম্বা।
গাংনী উপজেলার ভোমরদহ গ্রামের খামারি আনোয়ারুল ও লাভলী দম্পতি পেশায় পশু পালনকারী। প্রায় দুই দশক ধরে তারা গরু, ছাগল পালনের সঙ্গে যুক্ত। চার বছর আগে মেয়েরা ভেড়ার মাংস খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে শখের বসে তিনটা গাড়ল কেনেন তারা।
দুই বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা এক জাতের দুম্বা ও দেশীয় গাড়লের মধ্যে সংকরায়নের কাজ শুরু করেন। কয়েক প্রজন্মের প্রজননের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সংকর জাত তৈরি করতে সক্ষম হন। শখের বসে গাড়ল পালন করতে গিয়ে এখন তারা একটি খামারের মালিক। বর্তমানে তাদের খামারে ৪০টি গাড়ল ও ১ টি পুরুষ দুম্বা আছে। এ দম্পতি এখন স্বপ্ন দেখছেন খামারটি আরও বড় করার। যেখানে বেকারদের কর্মসংস্থান হবে।
এ দম্পতি অভিন্নসুরে বাসসকে বলেন, চাষাবাদে লোকসান হওয়ায় প্রায় ২০ বছর আগে বাড়িতে গরু-ছাগল পালন করা শুরু করি। সব সময় ৬-৮ টি গরু এবং ১৫-২০ টি ছাগল বাড়িতে থাকত। মেয়েদের মাংসের চাহিদা মেটাতে ছাগল জবাই করতাম মাঝে মাঝে। বছর চারেক আগে মেয়েরা ভেড়ার মাংস খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে বাজার থেকে তিনটা গাড়ল কিনে আনি। একটা জবাই করি। বাকি দুটো গাড়ল পালন করি।
পাঁচ মাস পোষার পর দুটো বাচ্চা হয়। সেই থেকে সিদ্ধান্ত গাড়লের খামার করার। আমার লক্ষ্য ছিল এমন একটি জাত তৈরি করা, যেটি আমাদের দেশের আবহাওয়ায় সহজে মানিয়ে নিতে পারবে এবং কম খরচে বেশি মাংস উৎপাদন হবে।
আনোয়ারুল বলেন, দুম্বার মাংস বেশি হয়, আর গাড়ল রোগ-সহনশীল এই দুই গুণ একত্র করতে চেয়েছিলাম। সেই লক্ষ্যে দুই বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা একটি দুম্বা ও দেশীয় গাড়লের মধ্যে সংকরায়নের কাজ শুরু করি। গরু ছাগলের চেয়ে গাড়ল পালনে কম খরচে লাভ বেশি। বাড়িতে তেমন খাবার লাগে না। সারাদিন মাঠ-ঘাট, আগান- বাগানে চরে খাবার খায়। তিন বিঘা জমিতে ঘাস চাষ করেছি। মাঠে চরে আর এই ঘাস দিয়েই গাড়লের খাদ্য চাহিদা মেটে। বাড়তি খাবারের তেমন দরকার হয় না।
দিনে দুই থেকে তিনবার গাড়লের ঘর পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয়। মাচা পদ্ধতিতে চাষ করলে একবার ঘর পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয়। শরীরে লোম বড় হয়ে গেলে কেটে দিতে হয়। লোম বিক্রি হয় শুনেছি। কিন্তু কোথায় বাজার জানা নেই। এসব কাজ নিজেই করেন বলে জানান লাভলী খাতুন।
এ দম্পতি জানান, নতুন জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি খুব দ্রুত বাড়ে। সাধারণত সাত থেকে আট মাস বয়সেই বাজারজাত উপযোগী হয়ে ওঠে। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ সংকর গাড়লের ওজন গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে, যা সাধারণ দেশি গাড়লের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। প্রতি বছর দুইবার বাচ্চা দেয়।
তারা জানান, এই সফল সংকরায়ণ ও লাভজনক পশুপালনের গল্প এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের খামারে আসা দর্শনার্থীরা দেখে আশ্চর্য হন কিভাবে কম খরচে দ্রুত মাংস উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। অনেকেই এখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুম্বা-গাড়লের সংকরায়ণ সম্পর্কে জানতে চাইছেন।
উপজেলার আরও কয়েকজন খামারি বাসসকে জানান, আনারুল ভাইয়ের গাড়ল সংকরায়ণ দেখে আমরা নতুন করে গাড়ল পালনের দিকে ঝুঁকছি। আগে ছিল সন্দেহ, এখন নিশ্চয়তা পেয়েছি যে সংকর জাত আমাদের এলাকার জন্য ভালো হতে পারে।
আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে তিনি তার খামার থেকে ১০টি সংকর গাড়ল বিক্রি করেছেন। ক্রেতারা তা নিয়ে সন্তুষ্ট। চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়াই নিজেরা পশুদের চিকিৎসা দেন। দির্ঘদিন থেকে পশু পালন করতে করতে তাদের ধারণা তৈরি হয়ে গেছে কখন কোন ওষুধ, ইনজেকশন দিতে হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে ফোন দিয়ে তাদের কাছে গাড়লের বাচ্চা কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন অনেকে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুব্রত কুমার ব্যানার্জি বলেন, এ ধরনের সফল উদ্ভাবন আমাদের প্রাণিসম্পদ শিল্পকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে। খামারিদের জন্য সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে এই জাত দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এ সফল দম্পতির গল্প অন্য খামারিদের নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে।