\ আব্বাছ হোসেন \
লক্ষ্মীপুর, ২৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : জীবিকার তাগিদে ১২ বছর আগে কোরিয়া গিয়েছিলেন লক্ষ্মীপুরের আজিম হোসেন। চাকরি নিয়েছিলেন মাল্টা বাগানে। সেখানে মন টেকেনি। তবে মাল্টা চাষের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ তিনি ভালোভাবেই নিয়েছিলেন। প্রবাস জীবনের একাকিত্ব এবং অনিশ্চয়তা যখন তাকে কষ্ট দিচ্ছিল তখনই নিজ দেশে ফিরে মাল্টা চাষ করার সিদ্ধান্ত নেন আজিম। প্রবাসে বাগানে কাজ করার সময় তিনি মাল্টা ফলের চারা উৎপাদন, রোপণ ও পরিচর্যা এবং ফল বাজারজাতসহ সব ধরনের কাজ শিখে নেন।
রায়পুর উপজেলার চরবংশী ইউনিয়নের হাজিমারা গ্রামের বাসিন্দা নেছার আহমেদ ভুইয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র আজিম হোসেন (৪৭)। কোরিয়ান ভাষা শিখে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে ২০১৩ সালে ভাগ্য বদলের আশায় দক্ষিণ কোরিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে ৬০ হাজার টাকা বেতনে চার বছর মাল্টা বাগানে চাকরি করেন। ২০১৬ সালের শেষে দেশে ফিরে এসে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে নিজেই মাল্টা বাগান শুরু করেন। ২০২০ সাল থেকে মাল্টা ধরা শুরু হয়। প্রথম বছর লোকসান হলেও ২০২২ সাল থেকে লাভ হতে থাকে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে আয় করছেন ১০ লাখ। এভাবেই পাল্টে যায় আজিমের ভাগ্যের চাকা। পরিবার পরিজনহীন প্রবাস জীবন থেকে দেশে ফিরে অনেকটাই বেশি আয় করছেন তিনি।
আজিম হোসেন দেশে ফিরে প্রতিবেশীর কাছ থেকে ৮ একর জমি দীর্ঘ মেয়াদে লিজ নিয়ে ২০১৭ সালে মাল্টার বাগান করার উদ্যোগ নেন। নব উদ্যমে শুরু হয় দুই ভাইয়ের নতুন উদ্যোগ। প্রথমে রাজশাহী থেকে প্রায় ১৫০০ মাল্টা গাছের চারা সংগ্রহ করে লিজ করা জমিতে লাগান। চরাঞ্চলে শুকনো মৌসুমে পানিস্বল্পতায় কিছু গাছ মারা গেলেও বর্তমানে তার বাগানে এক হাজারের বেশি মাল্টাগাছ রয়েছে। যার প্রতিটি গাছে এখন কমপক্ষে ৫০ কেজি করে মাল্টা ধরে।
আজিম হোসেন বাসসের সাথে আলাপকালে জানান, গত বছর মাল্টা বিক্রি করে আয় করেছেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। মাল্টা চাষে তাদের ভাগ্য বদল হয়েছে। এখন আর জীবিকার জন্য কারো চাকরি করতে হয়না। ফিরে এসে ছোট ভাই মোক্তারকে সঙ্গে নিয়েই শুরু করেন মাল্টার চাষ। মাল্টা চাষ করে দুই ভাই এখন স্বাবলম্বী। পাশাপাশি তারা গ্রামের অন্যদের মাল্টা চাষ করার জন্য উৎসাহিত করছেন।
তাদের উৎপাদিত মাল্টা লক্ষ্মীপুরের একাধিক ফলের আড়তে পাইকারি দরে বিক্রি হয়। আড়তদার বাজারের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে তাদের প্রতি কেজি মাল্টা ৮০ টাকা থেকে ১২০ টাকা করে দাম দেন। এছাড়া বাগান থেকে ক্রেতাদের কাছে প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে বিক্রি করে থাকেন। যেখানে বিদেশ থেকে আমদানি করা মাল্টা প্রতি কেজি ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়, সেখানে আজিমের বাগানের মাল্টা বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। বিদেশ থেকে আমদানি করা মাল্টা কমলা রঙের হলেও আজিমের উৎপাদিত মাল্টা হালকা সবুজ ও হলুদ রঙের মিশ্রণে হয়ে থাকে। স্বাদে তাদের উৎপাদিত মাল্টা এবং আমদানি করা মাল্টার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উৎপাদিত মাল্টায় কোনো রকমের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়না।
দুই ভাইয়ের মালটা ব্যবসার পোশাকি নাম ভুঁইয়া ফ্রুটস ফার্ম। এই ফার্ম থেকে গত মৌসুমে মাল্টা বিক্রি করে তাদের নিট আয় হয়েছে ১০ লাখ টাকা। এখন আবারো ফল ধরতে শুরু করেছে। আগামী মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে ফলন পুরোপুরি আসবে। মাল্টা ফলের বৈশিষ্ট্য হলো এক মৌসুমে ফলন বেশি হলে পরের মৌসুমে তার চেয়ে কম হয়। আবার তার পরের বছর ফলন বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিনই জেলা ও জেলার বাইরে থেকে দর্শনার্থী এবং ক্রেতারা ভিড় করেন তাদের বাগানে।
মোক্তার হোসেন বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, প্রথমদিকে মাল্টা চাষের সফলতা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে সংশয় এবং সন্দেহ দেখা দিলেও পরবর্তী সময়ে আমাদের সফলতায় সবাই খুশি। মাল্টা চাষে উপজেলা কৃষি অফিস সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে। পানির অভাব দূর করার জন্য আমাদের বাগানে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে একটি শ্যালো পাম্প মেশিন স্থাপন করে দিয়েছে। ফলে এখন আর শুকনো মৌসুমে পানির জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয় না।
তিনি জানান, বাগানের ফল থেকে কলম ও চারা উৎপাদন শুরু করে দিয়েছেন। আগ্রহী চাষিদের কাছে মাল্টা ফলের কলম ও চারা বিক্রি করে তাদের মাল্টা চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। যুবকদের মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তারা প্রতিটি কলম ১৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি করে থাকেন। এরই মধ্যে কয়েকজন যুবক তাদের কাছ থেকে কলম সংগ্রহ করে বাগান তৈরি করেছেন।
লক্ষ্মীপুর শহরের উত্তর তেমুহনীর ফল ব্যবসায়ী জহির বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরের উৎপাদিত মাল্টা ফলের রং আমদানি করা ফলের তুলনায় কম হলুদ হওয়ায় প্রথমদিকে মানুষ কিনতে আগ্রহী ছিলেন না। অনেকের ধারণা ছিল ফল টক হবে, স্বাদ হবে না। ক্রেতাদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে বিক্রি করতাম। এখন অধিকাংশ ক্রেতাই এসে লক্ষ্মীপুরের মাল্টার খোঁজ করেন।’
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইউসুফ হোসেন বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরে উৎপাদিত মাল্টা এত সুস্বাদু হবে তা খাওয়ার আগে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এখন দেখি আমদানি করা বিদেশি মাল্টা থেকে এই জেলায় উৎপাদিত মাল্টা অনেক বেশি স্বাদের।’
লক্ষ্মীপুর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল মো. হাবীবুর রহমান সবুজ বলেন, ‘মোক্তার ও আজিমের এই মাল্টার চাষ সত্যি প্রশংসনীয়। তাদের মতো অন্য বেকার যুবকেরা মাল্টা চাষে এগিয়ে এলে একদিকে দেশে বেকারত্বের অবসান হবে। অপরদিকে বিদেশি ফল আমদানিতে ব্যয় কমে যাবে। এতে দেশের অর্থনীতি সচল হবে।’
জেলা কৃষি কর্মকর্তা সোহেল মোহাম্মদ সামছুদ্দিনি ফিরোজ বলেন, ‘আজিম ও মোক্তারকে কৃষি বিভাগ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। অন্য কেউ এই মাল্টা ফল চাষ করতে আগ্রহী হলে তাদেরও কৃষি বিভাগ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
তিনি বলেন, দুই ভাই মাল্টা চাষ করে সফল হয়েছেন। বর্তমানে মাল্টা বাগানের কিছু গাছে মাল্টা ধরেছে। আবার অনেক গাছে ফুল আসছে। আগামী মার্চের মাঝামাঝিতে পুরোপুরি ফলন আসবে। তবে এবার ভালো ফলন হবে বলে আশা করছি।