লিয়াকত হোসেন লিংকন
গোপালগঞ্জ, ২৮ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি ঝোঁক ছিল তার। স্বপ্ন দেখতেন একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার। সেই স্বপ্নকে সত্যি করতে পড়ালেখার পাশাপাশি মাত্র দুই বিঘা জমিতে শুরু করেন কৃষি খামার। আজ সেই খামার ৫২ বিঘায় বিস্তৃত। বছরে তার আয় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। বলছি সফল কৃষি উদ্যোক্তা এম এম হাসিব হাসানের কথা।
হাসিব গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার জঙ্গলমুকুন্দপুর গ্রামের আবু সাঈদ মৃধা ও হাজেরা পারভীন দম্পত্তির ছেলে। ২০১৬ সালে হাসিব অনার্স পড়াকালীন বাবার দেওয়া দুই বিঘা জমিতে ১৫০টি আমের চারা ও তিনটি গরু নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার চরবকজুড়ি এলাকায় মায়ের নামে গড়ে তোলেন ‘হাজেরা এগ্রো ফার্ম’। কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার খামারের পরিধি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাসিবের খামারে বর্তমানে ৬০টি উন্নত জাতের গরু রয়েছে। খামার থেকে প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। খামারে উৎপাদিত দুধ স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে নিয়মিতভাবে রাজধানী ঢাকার বড় বড় মিষ্টির দোকানে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া খামারের গোবর থেকে ট্রাইকো কম্পোস্ট জৈব সার উৎপাদন করা হয়। যা নিজের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও বিক্রি করা হচ্ছে। গুণগত মান ভালো হওয়ায় হাসিবের সারের বেশ চাহিদা ও সুনাম রয়েছে। গরুর খামারের পাশাপাশি তার বিশাল আম বাগানে প্রতি বছর প্রচুর আম উৎপাদন হয়। আমেরও চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে।
মাস্টার্স পাস হাসিব আজ একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। ব্যক্তি জীবনে তার স্ত্রী ও একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। তাঁর এ সাফল্য শুধু তার পরিবারের জন্যই নয়, এলাকার অন্যান্য যুবকদের জন্যও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি প্রমাণ করেছেন, কৃষি শুধু পেটের দায়ে করা কাজ নয়। সঠিক পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রমে কৃষিখাত হয়ে উঠতে পারে একটি সম্মান ও লাভজনক পেশা। তার মতে, ‘কৃষিকে পেশা হিসেবে নিলে কেউ বেকার থাকবে না।’ হাসিবের এই অদম্য যাত্রা গোপালগঞ্জের কৃষি খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
উদ্যোক্তা এম এম হাসিব হাসান বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষা নিয়ে যে শুধু চাকরি করতে হবে। এমন কোনো কথা নেই। সবাই চায় তার নিজের একটা প্রতিষ্ঠান হোক, আমিও তাই চেয়েছিলাম। তিনটি গরু দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার খামারে গরুর সংখ্যা ৬০। ছোটবেলা থেকেই আমি ভেবেছিলাম অন্যের অধীনে চাকরি না করে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো। গত ৯ বছরে আমার পরিশ্রমের দ্বারা তা সম্ভব হয়েছে। আমার এই কৃষি খামারে মোট ১৫ জন কর্মচারী কাজ করছেন। আমি তাদের পরিবার নিয়ে খামারে থাকার সুযোগও করে দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার এই কৃষি খামার থেকে কর্মচারীদের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ শেষে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা আয় হয়। যা চাকরি করলে সম্ভব হতো না। আমি শিক্ষিত যুবকেরদের বলতে চাই আপনারা চাকরির আশা না করে নিজে উদ্যোক্তা হন।’ হাসিবের এই অদম্য যাত্রা শুধু তাকেই স্বাবলম্বী করেনি। এলাকার বেকার তরুণদের মাঝেও নতুন করে আশা জাগিয়েছে।
মামুন মীর নামে স্থানীয় এক তরুণ বলেন, ‘আমরা এতদিন কৃষি কাজকে শুধু গ্রামের সাধারণ মানুষের পেশা হিসেবেই দেখতাম। কিন্তু হাসিব ভাইয়ের সাফল্য দেখে আমাদের ধারণা পাল্টে গেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, উচ্চ শিক্ষিত হয়েও কৃষি খামার করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। আমি নিজেও এখন তার মতো কিছু একটা করার কথা ভাবছি।’
কৃষি খামারের কর্মচারী মো. রফিক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা এই খামার ও বাগানের কাজ করছি। মাসে আমাদের প্রতিজনের বেতন পনেরো থেকে বিশ হাজার টাকা করে। এখানে কাজ করেই আমাদের ১৫টি পরিবারের সংসার চলে। আমাদের মালিক খুব ভালো মনের একজন মানুষ। মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের বেতন পরিশোধ করে দেন।
কাশিয়ানী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাজী এজাজুল করীম বলেন, ‘হাসিবের মতো শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তারা আমাদের কৃষিখাতের ভবিষ্যৎ। হাসিব প্রমাণ করেছেন কৃষিকে একটি লাভজনক পেশা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
তার এ সাফল্য দেখে এলাকার আরও অনেক বেকার যুবক কৃষি কাজে আগ্রহী হচ্ছেন। কৃষি বিভাগ সব সময় এমন উদ্যোক্তাদের পাশে আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে। আমরা নিয়মিত তাকে পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি।’