।। মো. মঞ্জুর মোর্শেদ।।
মুন্সীগঞ্জ, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হলো বাঙ্গালী এবং হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এটি মূলত দেবী দুর্গার পূজা ও মহিষাসুরের ওপর দেবীর বিজয়ের স্মরণে পালিত হয়। বাংলায় দুর্গাপূজা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক মিলনের অন্যতম বড় উৎসব।
দুর্গাপূজার উৎপত্তি প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ইতিহাস মতে এ এলাকায় প্রথম দুর্গাপূজা চালু হয়েছিল ১৫৮০ সালে রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়নের মাধ্যমে। মুন্সীগঞ্জের অতীতের দুর্গাপূজা ছিল বাঙ্গালীর জমিদারী যুগের সাংস্কৃতিক এক সমৃদ্ধ অধ্যায়। মুন্সীগঞ্জ ঐতিহাসিক ভাবে শিক্ষিত, সাংস্কৃতিক এবং সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। এখানে দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবের প্রধান কেন্দ্র ছিল।
মুন্সীগঞ্জ জেলার ভাগ্যকুলের রাজবাড়ীতে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় প্রথম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটি বিক্রমপুরের প্রাচীনতম দুর্গাপূজা হিসেবে বিবেচিত।
এ পূজায় স্থানীয় জমিদাররা অংশগ্রহণ করতেন। বিক্রমপুরের জমিদারদের বাড়ি ছিল একটি ঐতিহাসিক স্থান, যেখানে নিয়মিত দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। এ পূজায় শুধুমাত্র জমিদার পরিবারের সদস্যরা অংশগ্রহণ করতেন এবং এটি ছিল আড়ম্বরপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান। সে সময় দুর্গাপূজা হতো রাজবাড়ীর প্রাঙ্গণে ঠাকুরশালায়, স্থায়ী বা নাট মন্দিরে।
আর দুর্গাপূজার আয়োজক এবং খরচ বহন করতেন জমিদারগণ বা বিত্তশালী হিন্দু পরিবারের সদস্যগণ। দুর্গাপূজা ছিল সে সময় জমিদারদের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক।
পূজা উপলক্ষ্যে পূজামন্ডপে স্থানীয় নেতা, আইনজীবী ও কবি সাহিত্যিকেরা একত্র হতেন।
ব্রিটিশ আমলে মুন্সীগঞ্জের দুর্গাপূজা নবজাগরণের ধারাকেও সমৃদ্ধ করেছিল। দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি ছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। পূজার সময় বিভিন্ন পূজামন্ডপ এলাকায় সাহিত্যসভা, কীর্তন, নাটক, পালাগান, যাত্রানুষ্ঠান, কবিগান এবং শিক্ষামূলক আলোচনা সভা হতো। কালের বিবর্তনে ইট পাথরের যুগে এখন আর সে সব অনুষ্ঠান নেই।
১৯শ শতকের শেষভাগে ও ২০শ শতকের শুরুতে মুন্সীগঞ্জে সার্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হয়। বর্তমানে মুন্সীগঞ্জে দুর্গাপূজা আর আগের মতো জমিদার বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন সার্বজনীন পূজা হিসেবে পাড়ায় পাড়ায় উদযাপিত হয়। এলাকা বা মহল্লার লোকেরা একসাথে চাদাঁ তুলে, বিভিন্ন খোলা মাঠে অস্থায়ী পূজামন্ডপ তৈরি করে পূজা করে থাকেন। সময়ের সাথে সাথে পূজা উদযাপনের সামগ্রিক চিত্র পাল্টালেও এখনোও সর্বত্র পাড়া মহল্লায় সাজ সাজ রব পরে যায়। পূজামন্ডপে সকল ধর্মের বর্ণের শ্রেণিপেশার লোকদের মিলনমেলায় পরিনত হয়।
জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি এ্যাডভোকেট অজয় চক্রবর্তী বাসসকে বলেন, দেশ বিভাগের পূর্বে মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকুলের রাজা শ্রীনাথ রায়, যদুনাথ রায় ও কীর্তি নারায়নের জমিদার বাড়িতে নিয়মিত দুর্গাপূজা হতো।
সিরাজদিখানের শ্রীনাথ রায় চৌধুরী পরিবার, শ্রীনগরে বসাক পরিবার, টংগিবাড়ীতে দক্ষিণ বেতকার ঘোষালবাড়ী, আব্দুল্লাপুরের মন্ডলবাড়ী, দত্ত পরিবার ও বসু পরিবারে জাক জমকভাবে দুর্গাপূজা উদযাপিত হতো। এ ছাড়া সিংহপরিবার, গুহঠাকুরতা পরিবার চক্রবর্তী পরিবারে রাজকীয়ভাবে দুর্গাপূজা হতো। সে সময় জমিদার পরিবারের সদস্যরা যারা কলকাতায় ব্যবসা - বানিজ্য বা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করতেন তারা দুর্গাপূজায় মুন্সীগঞ্জে চলে আসতেন।
শুভ মহালয়া এবং শুভ বিজয়া দশমীর আগে ও পরে প্রায় এক মাস ধরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিভিন্ন যাত্রা, নৃত্যানুষ্ঠান, নাটক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। এখন দুর্গাপূজা সার্বজনিন হওয়ায় পূজামন্ডপের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। জেলায় এ বছর ৩৫৮টি পূজামন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগে সরকারিভাবে আর্থিক কোন সাহায্যে সহযোগিতার বিষয় ছিলনা। এখন সরকারি ভাবে প্রতিটি পূজামন্ডপে আর্থিক সাহয্যে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
পৌর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ভবতোষ চৌধুরী নুপুর বলেন, মুন্সীগঞ্জ সদরে শহরের কালীবাড়ী পূজামন্ডপে সবচেয়ে বড় পরিসরে জাকজমকভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা উপলক্ষে সকলের সহযোগিতায় পূজামন্ডপ ধর্মবর্ণ শ্রেণিপেশা নির্বিশেষে সকলের মিলনমেলায় পরিনত হয়। তিনি বলেন, এ মন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়না। সারা বছর মন্ডপে প্রতিমা সংরক্ষণ করে পূজা অর্চনা করা হয়। আসন্ন পূজা উপলক্ষে সনাতনী ধর্মালম্বীরা কেনা কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিমা তৈরির কারিগররা প্রতিমায় রং তুলির শেষ আচর এবং সাজ সজ্জার কাজ করছেন।
তিনি আরও বলেন, আগামী দুই একদিনের মধ্যে মন্ডপে মন্ডপে প্রতিমা চলে যাবে। পূজামন্ডপ কর্তৃপক্ষ পূজামন্ডপে আলোক সজ্জা এবং বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে পূজার মূল পর্ব শুরু হয়ে ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মাধ্যমে পূজার পরিসমাপ্তি ঘটবে।