ঢাকা, ৬ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং দেশের প্রধান প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক সংলাপে ভোটারদের আস্থা পুনঃস্থাপন, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা কমিশনের কাছে সরাসরি আহ্বান জানান, বিতর্ক ও রাজনীতির বাইরের প্রভাব এড়িয়ে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
তারা বলেন, জুলাই শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করলে দেশের গণতন্ত্রের গুরুতর ক্ষতি হবে এবং আগামী দিনের অগ্রগতি থেমে যাবে।
আজ সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ. এম. এম. নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এতে উপস্থিত ছিলেন চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সংলাপে দেশের প্রভাবশালী সাংবাদিক, সম্পাদক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা অংশ নেন এবং তারা ভোটাদের আস্থা, নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, অর্থের খেলা-বিরোধী ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য কমিশনের প্রতি তাদের সুস্পষ্ট প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
কমিশনের নৈতিক শক্তি ও মেরুদণ্ড সোজা রাখার পরামর্শ দিয়ে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা বলেন, ইসির সামনে দুটি রাস্তা রয়েছে। ভালো নির্বাচন করে আপনারা নায়ক হতে পারেন। আবার অতীতের মতো খারাপ নির্বাচন করে ভিলেন হতে পারেন।
তারা বলেন, দেশে নির্বাচন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গত তিনটা নির্বাচন ভোটারবিহীন হওয়ার কারণে নির্বাচনের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রথমেই উচিত আস্থা ফিরিয়ে আনা।
সিনিয়র সাংবাদিকরা একমত হন, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ভোটারদের আস্থার সংকট।
তারা বলেন, গত তিনটি নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ ও নির্বাচনী ফলাফলের প্রতি অনেকের বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য গুরুতর সংকেত। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশনের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হবে এই ভোটারদের আস্থা পুনঃস্থাপন করা।
একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, ‘নির্বাচনের আগে যে অর্থের খেলা শুরু হয়-মনোনয়ন বাণিজ্য, ভোট কেনা, এমনকি কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করার মতো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কমিশন যদি এই বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান না নেয়, তাহলে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া কখনোই বিশ্বাসযোগ্য হবে না।’
সংলাপে আরও বলা হয়, যারা ইতোমধ্যে মনোনয়ন কিনতে বা ভোট কিনতে আগ্রহী, তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনকে তফশিল ঘোষণার দিন থেকেই কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। তারা আশাবাদ প্রকাশ করেন, কমিশন এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে এবং ভোট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে।
সিনিয়র সাংবাদিকরা বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, তাদের রক্তের সঙ্গে আমরা যেন বেঈমানি না করি। এটি শুধুমাত্র একটি দায়িত্ব নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা। এখন সময় এসেছে দৃঢ়তার পরিচয় দেয়ার।’
সংলাপে সিইসি এ. এম. এম. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা একটি ক্রান্তিলগ্নে দায়িত্ব নিয়েছি। এই নির্বাচন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপ নির্ধারণ করবে। আমরা চাই নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার ও অংশগ্রহণমূলক হোক। যেনতেন কোনো নির্বাচন হতে পারে না, কারণ তা জনগণের আস্থার জায়গা নষ্ট করবে।’
তিনি জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কমিশন ইতোমধ্যেই নির্বাচন প্রস্তুতিতে গুরুত্ব দিয়েছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদে সাড়ে ২১ লাখ মৃত ভোটার বাদ দেওয়া হয়েছে এবং ৪৫ লাখ বাদ পড়া ভোটারকে তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। নারীদের ভোটার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, যা পুরুষ ভোটারের তুলনায় প্রায় ৩০ লাখ কম ছিল।
সিইসি বলেন, ‘মানুষ ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। তাই আমরা সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছি, যার ফলে নারীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বেশি করে অংশ নিচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসীদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কমিশন একটি পোস্টাল ব্যালট প্রক্রিয়া চালু করেছে। ভোটের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের জন্যও ভোট প্রদানের সুযোগ রাখা হয়েছে। আমরা চাই ভোট দেওয়ার সব প্রক্রিয়া সহজ, নিরাপদ ও স্বচ্ছ হোক।’
তিনি গণমাধ্যমকে নির্বাচনের অংশীদার হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘আমরা চাই গণমাধ্যম আমাদের পাশে দাঁড়াক। তারা মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে মিডিয়ার সহায়তা অপরিহার্য।’
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, প্রবাসী ভোটারদের জন্য ১০ লাখ ব্যালট প্রস্তুত রাখা হবে। ভোটার রেজিস্ট্রেশনের ভিত্তিতে পরবর্তী ধাপ নির্ধারণ করা হবে। আমরা বিশ্বাসযোগ্যতা ও নৈতিকতার মাপকাঠিতে দাঁড়াতে চাই। যদি সবাই একযোগে কাজ করে, তাহলে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচন সম্ভব।