
।। আল-আমিন শাহরিয়ার।।
ভোলা, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): আজ ১০ ডিসেম্বর দ্বীপ জেলা ভোলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ভোলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর সারা দেশ স্বাধীন হলেও ভোলা স্বাধীন হয়েছিলো তারও আগে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর।
শক্রমুক্ত ভোলায় হাজারো মুক্তিকামী মানুষ সেদিন রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্লাস করেন। ১০ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে ভোলার লড়াকু সন্তানরা তখনকার ভোলা মহকুমার এসডিও অফিস বর্তমান জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের ছাদে উঠে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে উড়িয়েছিলেন লাল সবুজের স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা।
ভোলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভোলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিজেদের জীবন বাঁচাতে ১০ ডিসেম্বর কার্গো লঞ্চযোগে ভোলা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পালিয়ে যাওয়ার পর বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে ভোলাকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধারা।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চলে যাওয়ার পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং শুরু হয় আনন্দ মিছিল।
১৯৭১-এ দেশ রক্ষায় সারাদেশের ন্যায় ভোলাতেও চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ভোলা সরকারি স্কুল মাঠ, বাংলা স্কুল, টাউন স্কুল মাঠ ও ভোলা কলেজের মাঠের কিছু অংশে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ হয় ভোলার ঘুইংঘারহাট, দৌলতখান, বাংলাবাজার, বোরহানউদ্দিনের দেউলা ও চরফ্যাশন বাজারে। আর সম্মুখযুদ্ধে বিপুল সংখ্যক পাক সেনাকে হটিয়ে যুদ্ধে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন।
ভোলার খেয়াঘাট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারের ধরে এনে হত্যা করে তেঁতুলিয়া নদীতে ফেলে দেয়া হত। ওইসময় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের রক্তে লাল হয়ে যেত মেঘনা- তেঁতুলিয়া নদীর লোনা পানি। বহু নারীকে ক্যাম্পে ধরে এনে রাতভর নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা নির্যাতিত ৩০ জন বীরঙ্গনাকে ভোলার ওয়াপদা থেকে উদ্ধার করা হয়। তাদের চিকিৎসা শেষে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
আরো জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভোলা শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস চত্বর দখল করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাম্প বসায়। সেখান থেকে চালায় নানান পৈচাশিক কর্মকাণ্ড। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যা করে ওয়াপদা ভবনের পেছনে গণকবর দেয়া হয়। সেটি এখন বধ্যভূমি।
এসব বধ্যভূমি ও সম্মুখযুদ্ধের রণাঙ্গনের স্থানগুলোর মধ্যে শুধু মাত্র ভোলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বধ্যভূমি ও বাংলা বাজারে মুক্তিযুদ্ধের স্থান সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া ভোলার বর্তমান উপশহর বাংলা বাজারে মুক্তিযুদ্ধের স্থান সংরক্ষণের কাজ হলেও অন্যান্য বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের অপর স্থানগুলো এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি।
ভোলার বাংলা বাজারে ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই প্রাণ হারান।
মুক্তিযোদ্ধারা ভোলার অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যখন শহর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রস্তুতি নেন, ঠিক সেই সময় (১০ ডিসেম্বর) ভোররাতে পাকিস্তানি হানাদাররা চারদিকে গুলি ছুড়তে থাকে। তখন মুক্তিযোদ্ধা কাজী জয়নাল ও ফিরোজের নেতৃত্বে ১৩ জনের একটি বাহিনী তাদের পেছন থেকে ধাওয়া করলে হানাদাররা ভোর ৫ টায় ভোলার পুরান লাশ কাটা ঘরের পাশে রাখা একটি কার্গো লঞ্চে চড়ে ভোলা থেকে পালিয়ে যায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ সাংবাদিক এম এ তাহের বাসসকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভোলা ছিলো ৯ নং সেক্টরের মেজর জলিলের আন্ডারে। মুক্তিযোদ্ধারা দৌলতখান ও চরফ্যাশন থানায় আক্রমণ করে অস্ত্র সংগ্রহ করে। ওইসব অস্ত্র দিয়ে টনির হাট, দেউলা তালুকদার বাড়ি, বোরহানউদ্দিন বাজার, গুপ্তের বাজার ও গরুর চোখা এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর আসতে শুরু করে। ১০ ডিসেম্বর ভোলা হানাদার মুক্ত হয়। সেদিনের স্মৃতি কখোনো ভুলে যাবার নয়।
তিনি বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পালিয়ে যাওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে শহরের ভোলার খালে ব্যারিকেড দিয়ে তাদের লঞ্চের গতিরোধ করার চেষ্টা করে মুক্তিকামী জনতা। পরে অবশ্য চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় কার্গো লঞ্চটি ডুবে গেলে পাকিস্তানি হানাদারদের সব সদস্য নিহত হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব আলম নিরব মোল্লা জানান, তৎকালীন ভোলা পৌরসভার চেয়ারম্যানসহ শহরের একটি গ্রুপের সহায়তায় ১৯৭১ সালের ৬ মে দুপুর ১২ টায় বরিশাল থেকে লঞ্চযোগে ভোলার খেয়াঘাটে এসে নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এ খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে শহরের প্রায় বাড়িঘর ফাঁকা হয়ে যায়।
ভোলা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান সদস্য সচীব বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান বাসসকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ের প্রতি রাতেই স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজন ধরে এনে হত্যা করত।
তিনি জানান, বিশেষ করে নারী ও যুবকরাই তাদের শিকারে পরিণত হত। এদেরকে নানান অত্যাচার নির্যাতন করে মেরে ওয়াপদার পূর্ব দিকের দেয়ালের বাইরে পুতে ফেলত। সন্ধ্যার পরে ট্রাকে করে লোকজনকে ভোলা খেয়াঘাট নিয়ে গুলি করে নদীতে ফেলে দিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
এদিকে আজ ১০ ডিসেম্বর যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালন করেছে ভোলার প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং বিভিন্ন শ্রেনি-পেশার মানুষ।
সকাল ১০ টায় জেলা প্রশাসক ডা. শামীম রহমানের নেতৃেত্ব একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করা হয়। এরপর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে দিবসটির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা সভা হয়। এ সভায় জেলা প্রশাসক, মুক্তিযোদ্ধা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।