আজ টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস

বাসস
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:৩৩
ছবি: বাসস

মহিউদ্দিন সুমন

টাঙ্গাইল, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): আজ ১১ ডিসেম্বর, টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস।  ১৯৭১ সালের এই দিনে জেলার দামাল ছেলেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের কবল থেকে টাঙ্গাইলকে মুক্ত করে। 

উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সেই থেকে দিনটি টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

যুদ্ধকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত কাদেরিয়া বাহিনীর বীরত্বের কথা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার বহেড়াতৈলে অবস্থান করে মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল ছিল স্বাধীন। ২৬ মার্চ সকালে টাঙ্গাইল পৌর শহরের আদালত পাড়ার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাসভবনে এক সভায় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হয়।

এরপর সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক ও সশস্ত্র গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান ও আব্দুল কাদের সিদ্দিকীসহ আরও ৮ জনকে সদস্য করে ওই কমিটি গঠিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল মান্নান, গণপরিষদ সদস্য শামসুর রহমান খান শাজাহানের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।

২৭ মার্চ টাঙ্গাইল শহরের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত এক সভায় টাঙ্গাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ওইদিন রাতেই সার্কিট হাউজ আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। অতর্কিত ওই আক্রমণে ২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় ও ১৫০ জন আত্মসমর্পন করে। এরপর থেকে গ্রামে গ্রামে যুবকরা সংগঠিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণও চলতে থাকে।

টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে যাওয়ায় ঢাকা থেকে পাকবাহিনী ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইলে আসার চেষ্টা করে। পথে জেলার মির্জাপুর উপজেলার গোড়ান-সাটিয়াচড়া নামক স্থানে মুক্তিবাহিনী অগ্রগামী পাকবাহিনীর কনভয়কে প্রতিরোধে ব্যূহ রচনা করে। সেদিনের প্রতিরোধ যুদ্ধে ২৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। এরপর স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী ওই এলাকায় পাল্টা আক্রমন চালায় পাকরা। এতে মুক্তিযোদ্ধাসহ ১০৭ জন বাঙালি গণহত্যার শিকার হন। 

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩ এপ্রিল বিকেলে টাঙ্গাইল শহর দখল করে নেয়। ফলে টাঙ্গাইলের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ওই সময় পুরো বাহিনী টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকা সখীপুরের বহেড়াতৈলে চলে যান। সেখানে এ বাহিনীর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এবং রিক্রুট ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পরবর্তীকালে এ বাহিনীরই নাম হয় কাদেরিয়া বাহিনী। এ বাহিনীর প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ হাজারে। এছাড়া ৭০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও কাদেরিয়া বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রায় ৫ হাজার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং ৭ হাজার রাজাকার-আলবদর টাঙ্গাইলে অবস্থান করে। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের ৮ তারিখ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাজিত করে খান সেনাদের। এসব যুদ্ধে তিন শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

৮ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। জেলার কালিহাতীর পৌলী ব্রিজের পাশে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে পাক সেনাদের যুদ্ধ হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণভয়ে হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার দিকে পালায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী চারদিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে হানাদারদের টাঙ্গাইল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় কাদেরিয়া বাহিনী। ১০ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইলে প্রবেশ করেন কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক।

১০ ডিসেম্বর রাতেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইল সদর থানা দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ১১ ডিসেম্বর ভোরে পূর্বদিক দিয়ে শহরে প্রবেশ করেন কমান্ডার খন্দকার বায়েজিদ আলম ও খন্দকার আনোয়ার হোসেন, দক্ষিণ দিক দিয়ে আসেন ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান। আর উত্তর দিক থেকে ময়মনসিংহ সড়ক দিয়ে সাঁজোয়া বহর নিয়ে আসেন কাদের সিদ্দিকী। শহরের কাছাকাছি এলে পাকিস্তানি সেনারা জেলা সদর পানির ট্যাংকের ওপর থেকে কাদের সিদ্দিকীর সাঁজোয়া বহরের ওপর গুলিবর্ষণ করে।

এরপর পাল্টাগুলি গুলি ছুঁড়ে কাদের সিদ্দিকী ও তার বহর। একে একে নিহত হয় সেখানকার পাকিস্তানি সেনা। আত্মসমর্পণ করে সার্কিট হাউজে অবস্থানরত বেঁচে থাকা পাকিস্তানি সেনারা। সার্কিট হাউজ দখলে নেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করে এবং সারা শহর নিজেদের দখলে নিয়ে হানাদারদের ধরতে থাকেন। এভাবেই টাঙ্গাইল শহর সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত হয়।

দিবসটি উপলক্ষে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট গোলাম মোস্তফা মিয়া বলেন, ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস। এই দিনটি আমাদের জীবনের এক অমর দিন। এই শহরের প্রতিটি ইট-পাথরে শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতার এই গৌরবময় ইতিহাস জানতে হবে, ধারণ করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও ইতিহাস রক্ষায় সবাইকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বিগত ১৭ বছরে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে দলীয়করণের মাধ্যমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরি করেছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জোর দাবি জানান তিনি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট এর আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক মন্ডল জানান, ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত হয়। দিনটি  টাঙ্গাইলবাসীর জন্য স্মরণীয় দিন। সেদিন কাদেরিয়া বাহিনীর নেতৃত্বে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে টাঙ্গাইলকে হানাদার মুক্ত করেছিলেন তাদের কখনো অবমূল্যায়ন করা যাবে না। 

এদিকে টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস উদযাপন উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ড ও কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইলে দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, বিজয় র‌্যালি, লাঠিখেলা, আলোচনা সভা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধীদের ভয় দেখানো জন্য হাদিকে গুলি করা হয়েছে : সারজিস আলম
কূটনীতিকদের অংশগ্রহণে শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার ‘পিএস মাহসুদ’ যোগে ঢাকা-চাঁদপুর-ঢাকা রিভার ক্রুজ অনুষ্ঠিত
গুলিবিদ্ধ হাদির পরিবারের পাশে ডা. জুবাইদা রহমান
ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্র অধিকার পরিষদের বিক্ষোভ মিছিল
২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন তারেক রহমান
শামীম নির্বাচিত হলে হাতিয়া মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে : আমীর খসরু
ওসমান হাদির ভাইয়ের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফোনালাপ, সর্বোচ্চ সহযোগিতার নিশ্চয়তা
হাদিকে গুলির ঘটনা নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত : ইসলামী আন্দোলন
ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতারে কাজ করছে ডিএমপি
আবদুল মোমেন খান দেশে সর্ব প্রথম দারিদ্র্য ও খাদ্য সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটান : মঈন খান
১০