ঢাকা, ৩ জুন, ২০২৫ (বাসস) : দেশের অন্যতম বিচ্ছিন্ন উপকূলীয় জনপদ পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা। বঙ্গোপসাগরের মাঝে এক চিলতে ভূখণ্ড। এই উপজেলাবাসীর অধিকাংশের পেশা মাছ ধরা, পশু পালন ও কৃষি কাজ। তাই তারা তাদের সন্তানদের নিজ নিজ পেশার সাহায্যকারী হিসেবে ব্যবহার করতেন। বেশির ভাগ পরিবারই ছিল শিক্ষার আলো বঞ্চিত। পিছিয়ে পড়া এসব জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে সরকার বেশ আন্তরিক।
নিশী ইসলাম, রাঙ্গাবালীর হালিমা খাতুন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী। নিশী বলেন, আমরা দুই ভাই ও দুই বোন। বাবা একা পরিশ্রম করে আমাদের খাবার-লেখাপড়ার খরচ যোগান দেন। আমি আমার বাবার কষ্ট বুঝতে পারি। এ জন্য যত কষ্টই হোক আমি পড়াশোনা চালিয়ে যাবো যাতে পরবর্তীতে আমি আমার বাবার পাশে দাঁড়াতে পারি। আমার বাবা এখন আমার জন্য কষ্ট করছে, আমি বড় হয়ে বাবার সুখের হাতিয়ার হবো।
রাঙ্গাবালী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মৌসুমী আক্তার বলেন, আমি যৌথ পরিবারের মেয়ে, বাবার একার পক্ষে পরিবারের ভাই-বোন, দাদা-দাদি ও ফুফুর ভরণপোষণ যোগানো খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বাবার ইচ্ছে আমি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একজন মানুষের মত মানুষ হই। আমিও বাবার চাওয়া পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি প্রতিদিন প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কলেজে যাই যাতে আমি বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তাদের দুঃখ লাগব করতে পারি। আর এটাই আমার চাওয়া।
এক সময় বঙ্গোপসাগরের বক্ষে নতুন বালুচর সৃষ্টির ফলে কালের বিবর্তনে এই বালুচরে জনবসতি গড়ে ওঠে। এটা একটি বিছিন্ন দ্বীপে রূপ নেয়। এই চরের বালু রৌদ্রের তাপে লালিমায় চিকচিক করত এমনকি বালুগুলো লাল দেখাত, এই ‘লাল’ শব্দটি আঞ্চলিক ভাষায় ‘রাঙ্গা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এ থেকে ‘রাঙ্গাবালী’ নামের উৎপত্তি হয় বলে জানা যায়। এ জনপদে শিয়াল, কুকুর, হরিণসহ বন্যপ্রাণী বসবাস করত। তখনও এ জনপদে মানুষের দেখা মিলেনি। ইতিহাসবিদরা জানান, ১৭৮৪ সালে কতিপয় রাখাইন জনগোষ্ঠী আরাকান রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। তারা নদীর কূলে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে কাঁকড়া আর মাছ শিকার করতো। তখন থেকে এ অঞ্চলে জনবসতি শুরু হয়।
বিছিন্ন জনপদ রাঙ্গাবালী উপজেলার মানুষের জীবন যাত্রা খুবই নিম্নমানের। তারা সারাদিন রৌদ্রে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কৃষি কাজ করে। কেউ আবার উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে বান-বন্যা ও খাঁ-খাঁ রৌদ্রে মাছ শিকার করে। তারপরও তারা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সন্তানদেরকে মানুষের মতো মানুষ গড়ে তুলতে। সময়ের সাথে সাথে এ জনপদের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিরক্ষর থেকে মুক্তি দিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিরামহীন পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে রাঙ্গাবালী সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি যখন থেকেই এ কলেজে আসেছি, তখন থেকেই দেখছি প্রায় ছাত্র-ছাত্রী অনেক কষ্ট করে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কলেজে আসে। আমার কিছু ছাত্র-ছাত্রী আছে যাদের কলেজ থেকে বাসার দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। বর্ষা আসলে তারা খুব ভোগান্তিতে পড়ে। কাঁচা রাস্তার কারণে ঠিকমতো ক্লাস করতে পারে না। এই উপকূলের প্রায় পরিবারই অসহায়। কিন্তু তারপরও তারা সন্তানকে পড়াশোনা করানোর জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমরাও ছাত্র-ছাত্রীদের আমাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে ওদের পড়াশোনা ওরা চালিয়ে যেতে পারে।
হালিমা খাতুন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ নূরে আলম বিপ্লব বলেন, আমাদের ছাত্রীরা লেখাপড়ার প্রতি খুব মনোযোগী। তারা যদি অর্থনৈতিক সাপোর্ট ঠিক মতো পায় তাহলে ভবিষ্যতে এ উপকূলের ছাত্রীরা আর পিছিয়ে থাকবে না ভালো কিছু আমাদের উপহার দিতে পারবে। আমরাও ছাত্রীদের সার্বিক সহযোগিতায় সব সময় পাশে থাকি এবং থাকবো।
রাঙ্গাবালীর আমলিবাড়িয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার শিক্ষার্থী মোসা. সোনিয়া বলেন, আমি পরিবারের বড় মেয়ে। তিন বোন, ছোট এক ভাইকে নিয়ে আমাদের পরিবার। আমরা সবাই পড়াশোনা করি। আমাদের পড়াশোনার দায়িত্ব একা আমার বাবার পক্ষে চালানো কষ্টকর। বাবার মেরুদণ্ডের হাড্ডি ক্ষয়ে যাওয়ায় মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। তারপরও লেখাপড়ার কমতি দেই না। কারণ আমাকে মানুষের মত মানুষ হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আমি মেয়ে না হয়ে যদি বড় ছেলে হতাম পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে সাহায্য করতে পারতাম।
নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে আমলিবাড়িয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহমুদ বলেন, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনায় খুবই আগ্রহী। পরিবারের যদি পিছুটান না থাকে তাহলে তারা দেশকে ভালো কিছু উপহার দেবে। এখানে আগের তুলনায় অনেক এগিয়েছে শিক্ষার হার। উপকূলের আর শহরের শিক্ষা হারের পার্থক্য অচিরেই মুছে যাবে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা তা দেখিয়ে দেবে।
শিক্ষা অফিস থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে উপকূলীয় অঞ্চল রাঙ্গাবালীতে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে ৭৪৫ জন ছাত্রী। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭১২ ও ৮৪৭ জন।
দুই দশক আগেও উপকূলীয় এলাকায় শিক্ষার হার বাড়াকে অসম্ভব বলেই ধরে নিয়েছিল স্থানীয় লোকজন। কিন্তু শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে এ জনপদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা নিশ্চিতকরণের এই অসম্ভব কাজটিকে সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। মাত্র এক দশক আগেও এ জনপদে যেখানে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন, সেখানে এখন তা বেড়ে প্রায় শতভাগে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার। এ সরকারের কিছু কার্যকর ও শিক্ষামুখী উদ্যোগের কারণে দেশের সব অঞ্চলে বিদ্যালয় মুখী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
উপকূলীয় জনপদে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে লেগেছে বাহারি রং-এর ছোঁয়া। পুরো বিদ্যালয়ে ভেতর বাইরের দেয়ালে বিভিন্ন রং করা হয়েছে। এর ওপর আঁকা হয়েছে আলপনা, বিভিন্ন সত্য ও সুন্দর বাণী। স্কুলের সামনে রয়েছে মনোরম ফুলের বাগান ও একটি শহীদ মিনার।
এখন বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য ছেলে-মেয়েরা উদগ্রীব থাকে। অভিভাবকের আগেই ছেলে-মেয়েরা স্কুলে আসার জন্য তৈরি হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, বিদ্যালয়ে রয়েছে তাদের নানান খেলার সামগ্রী। তারা বলেন, স্কুলগুলোর চেহারা নান্দনিক হয়ে উঠেছে। এখন বিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেই মন ভরে যায়।
দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এ লক্ষ্য অর্জনে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাসম্পন্ন গুণগত শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার অনাদিকুমার বাহাদুর বলেন, চর অঞ্চলের নারী শিক্ষার হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ উপকূলের জনসংখ্যার তুলনায় নারীরা শিক্ষার দিকে পিছিয়ে নেই। তবে পরিবারগুলো সচেতন হলে ভবিষ্যতে তা আরো বৃদ্ধি পাবে। এখানকার নারী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করতে জীবন যুদ্ধে নামতে হয়। প্রথাগত রীতি অনুযায়ী পরিবারগুলো সচেতন না হওয়ার কারণে এ অঞ্চলে বাল্যবিবাহের প্রবণতা রয়েছে। তবে বর্তমানে বাল্যবিবাহ অনেকটা কমে গেছে। তাই নারী শিক্ষার হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।