আত্ম-অন্বেষণের দীক্ষা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন লালন ভক্তরা

বাসস
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:৪৮ আপডেট: : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৮:১৮
লালন স্মরণোৎসবে ভক্তদের ভিড়, সাধকের সাধনা, জ্ঞানের অন্বেষণ আর লালনের গানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল লালনের স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার লালনের আখড়া। ছবি : বাসস

আব্দুর রাজ্জাক

কুষ্টিয়া, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ বাউল সাধক লালন সাঁইয়ের আত্ম অন্বেষণের এই অমেয় বাণীর মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে মানবজীবনের সব সাধনার উৎস। মানবাত্মার প্রকৃত মুক্তির পথ। সেই পথ ধরে যারা আজও জ্ঞান সাধনায় রত, তারাই মিলিত হয়েছিলেন তিন দিনের লালন স্মরোণৎসবে। 

বাউল সাধক লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত হলো তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব। ভক্তদের ভিড়, সাধকের সাধনা, জ্ঞানের অন্বেষণ আর লালনের গানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল লালনের স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার লালনের আখড়া। দেশি-বিদেশি পর্যটক, বাউল, সাধক আর ভক্তদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল আখড়া প্রাঙ্গণ। লালনের আত্ম অন্বেষণের দীক্ষা নিয়েই যেন আজ তারা বাড়ি ফিরবেন।  

বাউল গানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা ও সুরসাধক লালন শাহ ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭ অক্টোবর, ১৮৯০) ছেউড়িয়ায় পরলোক গমন করেন। তাঁর জন্ম ও তিরোধান দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর তার তিরোধান দিবসে ভক্তবৃন্দ তাঁর সমাধিসৌধে সমবেত হন এবং তিন দিন ধরে সাধু সেবা ও সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

লালন গবেষকদের মতে, তাঁর জীবন ছিল এক রহস্যময় নদীর মতো শান্ত, গভীর অথচ প্রবহমান। লালন ছিলেন সমাজের বিভাজন ও ভেদাভেদে ক্লান্ত এক আত্মা। ফকির লালন সাঁই কোনো ধর্মের ফকির নন, তিনি ছিলেন মানবতার ফকির। যাঁর জীবন ছিল এক অন্তহীন সাধনা। নিজেকে জানার এবং মানুষকে ভালোবাসার মধ্যেই তিনি জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরেছেন। 

তাঁর গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তার গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সংগীতশিল্পীর কণ্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তাকেই ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়।

আধ্যাত্মিক এই মরমি সাধকের স্মৃতি বিজড়িত ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে গত ১ কার্তিক থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী লালন, স্মরণোৎসবে সমবেত হয়েছিলেন দেশ ও দেশের বাইরের ভক্ত, অনুরাগী এবং দর্শনার্থীরা। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই উৎসবে অংশ নেন। উৎসবে এসে লালন সাঁইয়ের মর্মবাণীই বারবার ধ্বনিত হয়েছে তাদের অন্তরে। 

স্মরণোৎসবে অংশগ্রহণকারী লালন অনুরাগী টুনটুন বাউল বাসসকে বলেন, ‘লালনের দর্শন মানবজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তিনি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ করতেন না, তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের ‘মনের মানুষ’ বা ‘আসল মানুষ’ এর কোনো ধর্ম, বর্ণ, বা লিঙ্গ নেই, এই ‘মানুষ’ বা ঈশ্বরই মানুষের মধ্যে বাস করেন। লালনের ভাষায়, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। যার অর্থ হলো, ‘মানুষকে ভালোবাসলে বা তার উপাসনা করলে নিজে খাঁটি মানুষ হওয়া যায়।’

লালন শিল্পী নুপুর নদীয়া লালনের মানবতাবাদে জাতিকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা যে জ্ঞান অর্জন করে, লালনের দর্শন ধারণ করে, সুফি দর্শন সাধনা করে সোনার মানুষ হতে চাই, তাতো হচ্ছে না। তাই আসেন, আমরা শুধু গান এবং আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে লালন শাহের দর্শন, তার সুফিবাদের দর্শন ধারণ করে প্রকৃত আদর্শ মানবতাবোধসম্পন্ন মানুষ হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলি।’

লালন অনুরাগী অধ্যাপক আসলাম উদ্দিন বাসসকে বলেন, আমরা প্রতিবছর সাঁইজির ধামে আসি। এখানে আসলে মনে প্রশান্তি অনুভব করি। এ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন স্মরোণৎসব আয়োজন করায়  লোক সমাগম অনেক বেশি হয়েছে। তবে লোক সমাগম বেশি হলে সার্বিক ব্যবস্থাপনার দিকে আরো নজর দিতে হবে।   
দর্শনার্থী লিয়াকত আলী বলেন, এবারই প্রথম জাতীয়ভাবে এই লালন উৎসব পালন করা হচ্ছে। এবার গ্রামীণ মেলার পরিবেশ ছিলো খুবই আকর্ষণীয়। 

গত শুক্রবার ১৭ অক্টোবর বিকেল থেকে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায় আধ্যাত্মিক গুরু লালন সাঁইয়ের স্মৃতি বিজড়িত ছেঁউড়িয়ায় শুরু হয় ফকির লালন শাহের জন্ম ও তিরোধান দিবস উপলক্ষে তিন দিনের স্মরোণৎসব। এ উপলক্ষে লালন ভক্ত, অনুরাগী, বাউলসাধক ও ফকিরেরা সেখানে অষ্টপ্রহর কাটিয়েছেন। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন লালনের বাণী। আত্মজিজ্ঞাসায় আত্মার মুক্তির পথ খুঁজেছেন। 

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ১৭ অক্টোবর বিকেলে তিন দিনের এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মেহেদী আহম্মেদ রুমী। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ( অতিরিক্ত সচিব) ফিরোজ সরকার আজ সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

লালন শাহের তিরোধান দিবসের এই আয়োজনে প্রতিবছর বেশ বড় পরিসরে মেলার আয়োজন করা হয়। জাতীয়ভাবে পালনের জন্য মেলার মাঠ সাজানো হয় পরিপাটি করে। এবারও সেরকম আয়োজন করা হয়েছে। আধুনিক মানের ১০০টি স্টল তৈরি করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। সেসব স্টলে বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। আজ ১৯ অক্টোবর ভাঙবে সেই মিলনমেলা। আনন্দ-বেদনার স্মৃতিবিজড়িত এই মেলা প্রাঙ্গণ ধীরে ধীরে শূন্য হবে দোল পূর্ণিমার অপেক্ষায়। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
পুলিশ সদস্যদের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ আইজিপির
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে নিহত সৈনিকদের সমাধিতে কুটনৈতিকদের শ্রদ্ধাঞ্জলি
তারেক রহমানের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সাক্ষাৎ : চব্বিশের শহীদ পরিবার বিএনপি’র সঙ্গে কাজ করবে
ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তির অনলাইন আবেদনের সময় বাড়ল
অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজপথ আর উত্তপ্ত হতে দেব না : সালাহউদ্দিন আহমেদ
মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে খেলাধুলা : হাসনাত আব্দুল্লাহ
৭ নভেম্বর শুরু হওয়া দলকে সংস্কার শেখাতে হবে না : মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল
রাজশাহীতে আইডিইবি’র ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত
আল্লামা ইকবালের ১৪৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঢাবি ও প্রেসক্লাবে সেমিনার
সাংবাদিকদের দলবাজি ত্যাগ করে পেশাদারিত্ব সমুন্নত রাখতে হবে : এম আবদুল্লাহ
১০