ঢাকা, ১৮ মার্চ, ২০২৫ (বাসস): সমাজে এমন কিছু রোগ আছে, যার জন্য কাউকে দায়ী করা যায় না। তেমনই একটি রোগ অটিজম। যার জন্য কাউকে দায়ী করা যায় না। অথচ এ জন্য অটিস্টিক শিশুর মাকেই বেশি কষ্ট পেতে হয়, একজন অটিস্টিক শিশুর মায়ের যেন কষ্টের শেষ নেই। যেমন সালেহা আক্তার (ছদ্মনাম)। সালেহা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সুমনকে (ছদ্মনাম)। প্রথমে দুই পরিবারের কেউই তাদের বিয়েটাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। বিয়ের তিন বছর পর সালেহার কোল জুড়ে আসে ছোট শিশু রেহান।
এক পর্যায়ে রেহানের কারণে উভয় পরিবারই সালেহা সুমনের বিয়ে মেনে নেয়। সুখেই চলছিল তাদের সংসার। ছেলের ১৮ মাস বয়সে মা সালেহা জানতে পারেন, তার সন্তান রেহান স্বাভাবিক শিশু নয়। রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করে জানতে পারেন, ছেলে অটিস্টিক। এটি জানার পর স্বামী সুমন ছেড়ে চলে যান সালেহাকে। বিদায় নিতে হয় শ্বশুর বাড়ি থেকেও। অটিস্টিক শিশুটিকে নিয়ে মা যেন অথৈ সাগরে পড়ে যান। এমনি করে কেটে যায় আট বছর। সাড়ে নয় বছরের রেহান এখন সাবেক পিজি হাসপাতালের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউডিজঅর্ডার এন্ড অটিজম (ইপনা) এর অটিস্টিক শিশুদের স্কুলে পড়ে। সালেহা রাজধানীর টিকাটুলি থেকে সপ্তাহে পাঁচ দিন ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যান, স্কুল শেষে ছেলেকে রিকসায় করে বাসায় ফেরেন।
সালেহার সঙ্গে কথা হয় ইপনাতে। শুধু স্বামী ছেড়ে গেছেন তাই নয়, পরিবারের অন্যরাও তাকে ভালো চোখে দেখেন না বলে জানালেন সালেহা। প্রতিবেশীরা তার ছেলেকে এড়িয়ে চলে, অনেকে ঠাট্টা-তামাশা করে। এটা যে শুধু সালেহার বেলায় ঘটেছে, তা নয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও সরকারের সংক্রামক ব্যধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির যৌথ এক গবেষণায় দেখা গেছে এক তৃতীয়াংশ অটিস্টিক শিশুর মায়েরা পরিবার ও প্রতিবেশীর কাছ থেকে নেতিবাচক আচরণ পেয়ে থাকেন।
গবেষণা মতে অটিস্টিক শিশুদের মায়েদের প্রায় অর্ধেক মানসিক রোগী হয়ে যায়। আইসিডিডিআরবির সংক্রামক ব্যধি শাখার বিজ্ঞানী আলিয়া নাহিদ বলেন, সবচেয়ে দুঃখের বিষয় শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগলেও অনেক মা চিকিৎসকদের কাছে যান না, যেতে পারেন না।
বিজ্ঞানীদের মতে অটিজম মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। এই সমস্যার করণে শিশু যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্ক করতে পারেনা। এরা একই কাজ বা আচরণ বার বার করে।
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে দেশে ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৭ শতাংশ অটিস্টিক। অটিজম গ্রামের চেয়ে শহরে এবং মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুদের মধ্যে বেশি।
রাজধানী ঢাকার অটিস্টিক শিশুদের জন্য প্রায় একশটি বিশেষ স্কুল আছে। ছয়টি বিশেষ স্কুলের ৩৮৮টি শিশুর মায়েদের নিয়ে আইসিডিডিআরবি এই গবেষণা করেছে। এই মায়েদের গড় বয়স ৩৯ বছর। ৭৭ শতাংশ মা ঘরে ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করেন না। ৫ শতাংশের স্বামী নেই, ২ শতাংশ বিধবা। ২০১৫ সালের মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জরিপের সময় শিশুদের গড় বয়স ছিল ১১ বছর ৭ মাস। ৭৯ শতাংশ শিশু ছিল ছেলে। তবে গবেষণার প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে-এতে গ্রামের মায়েদের সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়নি।
গবেষণায় দেখা গেছে ৪১ শতাংশ মা একাই অটিজম শিশুর দেখাশোনা করেন। ৫৯ শতাংশ মাকে সাহায্য করেন গৃহকর্মী, স্বামী, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, অন্য সন্তান এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবেশি।
এক তৃতীয়ংশ মায়ের অভিযোগ-প্রতিবেশিরা অটিস্টিক শিশুদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। অনেকে পাগল বলে, তাচ্ছিল্য করে। অনেকে আবার এমন শিশু দেখে ভয় পায়।
রাজধানীর গ্রীণ রোডের বাসিন্দা অপর্না দাশ গুপ্তার ছেলে অনিন্দ্য দে’র বয়স ২১ বছর। চার বছর বয়সে অটিজম শনাক্ত হওয়া পর পরিবারের সদস্য, নিকট আত্মীয় ও প্রতিবেশির কাছ থেকে ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন সময় নানাভাবে হেনস্থা হয়েছেন তিনি।
চোখের পানি মুছে হাসি মুখে তিনি বলেন, ‘স্কুলের অনুমতি নিয়ে ছেলের পাশে বসে থাকতাম। অন্য শিশুদের আপত্তি ছিল না। বেশ কয়েকমাস পর অন্য অভিভাবকদের আপত্তির কারণে আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হয়। স্কুলের সিড়িতে বসে অনেক কেঁদেছিলাম। সমাজ এখনো অটিস্টিক শিশুদের সমস্যা উপলদ্ধি করার মতো সচেতন নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ইপনার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শাহিন আখতার বলেন, শিশু অটিস্টিক হলে পরিবারের সবার ওপরই এর চাপ পড়ে, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন মা। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য সমাজ মাকে দোষ দেয়। শিশুর লালনপালনের জন্য মা চাকরি ছেড়ে দেন। অনেকের সংসার ভেঙ্গে যায়। শিশুকে আকড়ে থাকেন মা। এত চাপের মধ্যে মায়ের ঠিকমত ঘুম হয়না,অধিকাংশের শরীর ভেঙ্গে যায়।
সাধারণভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বিষন্নতায় ভোগে। গবেষণায় দেখা গেছে, অটিস্টিক শিশুদের মায়েদের মধ্যে এই হার ৪৫ শতাংশ। ৬০ শতাংশ মা ডায়াবেটিসসহ একাধি রোগে আক্রান্ত থাকার কথা বলেছেন।
এসব মায়ের সামাজিক সহায়তা দরকার আছে বলে গবেষণার উপসংহারে বলা হয়েছে। এই সহায়তা হতে পারে বাড়িতে,হতে পারে সন্তানের স্কুলে। তবে মায়েদের জন্য এমন কোনো কর্মসূচি নেই।
অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সঙ্গে পরিবারকল্যাণ, প্রাথমিক শিক্ষা, মহিলা ও শিশু এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয় জড়িত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক কমসূচি এ শিশুদের নিয়ে কাজ করে। কর্মসূচির সাবেক লাইন ডিরেক্ট অধ্যাপক এএইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, গবেষণায় এটা স্পস্ট যে, এ সব মায়েদের জন্য পৃথক সহায়তা দরকার।
সালেহা বলেন, সহায়তা তার খুবই দরকার। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর মায়ের সংসারে উঠে বুটিকের কাজ শুরু করেন তিনি। বলেন, ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারেন না বলে কাজটিও তার ঠিকমত চলছে না। ছেলেকে ফিজিওথেরাপিস্টের কছে নিয়ে যেতে পারছেন না, শিক্ষক দিতে পারছেন না। বাসাভাড়া, প্রতিদিনের রিক্সা ভাড়া যোগাড় করতেই খুব কস্ট হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সালেহা বলেন, ‘আমাদের মত মায়েদের জন্য কোথাও কিছু নেই।’