ঢাকা, ১১ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস): ঢাকার বাসিন্দা রবিউল (ছদ্মনাম)। পেশায় আয়কর আইনজীবী। প্রথম সন্তানের বয়স আট, পরের জনের বয়স তিন। প্রথম সন্তান সবকিছু স্বাভাবিকভাবে করছে—পড়াশোনা, ড্রইং, খেলাধুলা—সবই নিয়ম মেনে করে। কখনও কখনও আবার দুষ্টুমি করে, মায়ের বকাও শোনে। সংকট হলো পরের জনকে নিয়ে।
তিন বছরের মেয়েটি কথা বলে খুব কম। প্রথমদিকে তারা একে সহজভাবে নিলেও ধীরে ধীরে দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। স্বামী-স্ত্রী প্রায়ই এটা নিয়ে ভাবেন, আলোচনা করেন, সমাধান খোঁজেন।
নিজেরা সমাধান খুঁজে না পেয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক সব দেখে-শুনে তাকে একজন থেরাপিস্ট ও চাইল্ড স্পেশালিস্টের সঙ্গে আলাপ করতে বলেন। চাইল্ড স্পেশালিস্ট অনেকক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, শিশুটির ‘স্পিচ ডিলে’ আছে। এই কারণে সে খুব কম কথা বলে। সারাক্ষণ মোবাইল দেখে।
রবিউল যেভাবে সন্তানের সমস্যা বুঝতে পেরেছেন, অন্য অভিভাবকেরা কি তা পারছেন? বেশির ভাগই পারছেন না, কারণ হলো তাদের জানার সীমাবদ্ধতা।
দুই. এখন প্রশ্ন হলো, আপনার সন্তান কি স্মার্টফোনে আসক্ত? প্রশ্নটা আসলে এভাবে না করে করা উচিত—আপনার সন্তান কেন স্মার্টফোনে আসক্ত?
স্মার্টফোনে আসক্তির বিষয়টি শুরুর দিকে আতঙ্কের পর্যায়ে থাকলেও এখন অনেকেই তা মেনে নিয়েছেন। সুস্পষ্ট করে বললে, অভিভাবকেরা মানতে বাধ্য হয়েছেন। তার কারণ অবশ্য অনেক।
প্রথমে একটা বিষয় উল্লেখ করা জরুরি—স্মার্টফোন এখন জীবনযাপনের অংশ। হঠাৎ করে তা সরানোর কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু সেই স্মার্টফোন যদি আপনার গোটা সময় কেড়ে নেয়, সেটা স্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে তা একেবারেই অস্বাভাবিক।
করোনার আগে শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহারের পরিসর ছিল সীমিত, করোনার পরে তা বেড়েছে। প্রয়োজনেই বেড়েছে। এখন সেই প্রয়োজনই সহজ-স্বাভাবিক আঙ্গিকে রূপ নিয়েছে। এই সহজ-স্বাভাবিক রূপের আড়ালেই রয়েছে ভয়াবহতা। এর প্রতিকার অবশ্য আছে। প্রতিকার সম্ভবও। তা নির্ভর করে ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও আগ্রহের ওপর। প্রশ্ন হলো, অভিভাবকেরা কি আসলে আগ্রহী?
তিন. ২০২৪ সালে বাংলাদেশে শিশুদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশের মারাত্মক স্মার্টফোন আসক্তি রয়েছে। অন্যদিকে মাত্র ১৪ শতাংশ শিশু অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে।
আরও দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে ৪ জনই সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তি সম্পর্কে অবগত নন।
[প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল ২০২৪]
জানতে চেয়েছিলাম, আপনার সন্তান কেন স্মার্টফোনে আসক্ত? এর উত্তর গবেষণার মধ্যেই আছে। গবেষণা বলছে, ১৪ শতাংশ শিশু অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে। এই ১৪ শতাংশ শিশু বা তাদের অভিভাবকেরা পেরেছেন স্মার্টফোনকে শুধু অধ্যয়ন ব্যতীত অন্য কাজে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে। তারা স্মার্টফোন ব্যবহারকে আসক্তির পর্যায়ে নিয়ে যায়নি—নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন।
আবার যে ২৯ শতাংশ শিশুর স্মার্টফোনে আসক্তি মারাত্মক, তারা তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। ধীরে ধীরে বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে এই আসক্তি দূর করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন শিশুর মনোযোগ অন্যত্র স্থানান্তর করা। এটা সহজ নয়, কিন্তু সম্ভব—আর তা সময়, শ্রম ও ধৈর্যের ওপর নির্ভরশীল।
চার. এখনকার অভিভাবকেরা অনেক বেশি কর্মমুখর। যৌথ পরিবারের ধারণা ভেঙে একক পরিবার বেড়েছে, ফলে অভিভাবকদের বাড়তি কোনো সাহায্য থাকে না। অল্প মানুষ দিয়ে স্বল্প সময়ে অনেক কিছু করতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও সবসময় পেরে ওঠেন না। তখন শিশু বাধ্য হয়ে স্মার্টফোনকে আপন ভেবে নেয়।
এরপরের বিষয় হলো, অনিরাপদ পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। মোটাদাগে বলতে গেলে, শিশুরা অনিরাপদ। তারা পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক—কেউ-ই নিরাপদ নয়। প্রতিদিনের গণমাধ্যমের অসংখ্য প্রতিবেদন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর ফলে শিশুরা একাকী সময় কাটানোর জন্য স্মার্টফোনকে আপন ভাবছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, খেলার পরিবেশ ক্ষীণ হওয়া এবং পার্ক ও খেলার মাঠের স্বল্পতা। নগরায়ন বা দ্রুত বর্ধনশীল আবাসনে খেলার মাঠ বা পার্ক অবহেলিত এক প্রকল্প। নগর পরিকল্পনায় মাঠ বা পার্ক অলাভজনক বিষয় হিসেবে বিবেচিত। আবার পুরোনো যেসব মাঠ বা পার্ক রয়েছে, সেগুলোও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। ফলে শিশুরা মাঠ বা পার্ক না পেয়ে স্মার্টফোনে আসক্ত হচ্ছে।
এইসব সংকটের সমাধান সম্ভব—যদি রাষ্ট্র চায়। এখন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক চাল আর চিন্তার মধ্যে তো শিশুদের ফেলে রাখা যায় না। সময়ের সাথে সাথে তাদের জন্য বিভিন্ন কার্যকলাপ চালু রাখতে হবে।
শিশু যখন তার মনোযোগ অন্য কোনো কার্যকলাপের মধ্যে দেবে, তখন স্মার্টফোন আসক্তি ধীরে ধীরে কমে আসবে। এখন প্রশ্ন হলো, কী ধরনের কার্যকলাপে শিশুকে ব্যস্ত রাখা হবে?
শিশুর বয়স অনুযায়ী কার্যকলাপ নির্ধারণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে— ড্রইং, খেলাধুলা, গান, নাচ, আবৃত্তি, যন্ত্রসংগীত, অভিনয়, সাইক্লিং, সুইমিং, আর্টওয়ার্ক, ভাষা শেখানো, মার্শাল আর্ট শেখা, পরিচয়পর্ব (গাছ, ফুল, পাখি, সবজি, ফলমূল চেনানো), মাটি বা ক্লে দিয়ে বিভিন্ন কিছু তৈরি করা, শিশুপার্কে নিয়ে যাওয়া, চিড়িয়াখানায় ঘোরানো, গ্রামের বাড়ি বা ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটানো—এসবের সঙ্গে শিশুদের যুক্ত করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তারা শিশুদের নিয়ে এসব কাজ করাতে পারেন।
এছাড়া শহর বা নগরে বিভিন্ন ধরনের প্রি-স্কুল ও কেয়ার সেন্টার চালু রয়েছে, যদিও তা ব্যয়সাপেক্ষ। এসব সেন্টারে শিশুদের ব্যস্ত রাখার জন্য অনেক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। অভিভাবকেরা যাচাই-বাছাই করে শিশুদের এসব সেন্টারে যুক্ত করতে পারেন।
সবার আর্থিক সামর্থ্য এক নয়। যাদের সামর্থ্য সীমিত, তারা নিজে সময় দিয়ে সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন। তারা কী চায়, তা বুঝে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা সাজাতে পারেন। এক্ষেত্রে প্যারেন্টিং গাইডলাইন বড় সহায়ক হতে পারে।
এর ফলে স্মার্টফোনে আসক্ত শিশুদের তাৎক্ষণিকভাবে আসক্তি থেকে সরানো সম্ভব না হলেও ধীরে ধীরে তা কমিয়ে আনা সম্ভব।
পাঁচ. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকদের সার্বক্ষণিক যুক্ত থাকা প্রয়োজন। এতে শিশুরা বেশি কর্মমুখর বা প্লেফুল হয়ে ওঠে।
লেখা শেষ করছি একটা চলচ্চিত্রের ঘটনা দিয়ে। ২০২২ সালে রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত হাবজি গাবজি চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এটি ভারতের বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র।
গল্পটা এরকম—স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ব্যস্ত। ছেলেকে সময় দেওয়ার সুযোগ তাদের নেই। ছেলে নিজের একাকীত্ব কাটাতে স্মার্টফোনকে সঙ্গী বানায়। ধীরে ধীরে তার আসক্তি বাড়তে থাকে। অনলাইনে গেম খেলতে খেলতে এমন নেশায় পড়ে যায় যে, সারাক্ষণ স্মার্টফোন হাতে থাকে।
স্মার্টফোন সরানো নিয়ে একসময় বাবার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধে। ছেলের মনে হয়, বাবাই তার অনলাইন প্রতিপক্ষ।
শেষমেশ স্বামী-স্ত্রী বুঝতে পারেন, তাদের সন্তান ভয়াবহভাবে স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। তারা তা থেকে সন্তানকে মুক্ত করতে পারছেন না।
এইভাবে চলচ্চিত্রে স্মার্টফোন আসক্তির ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে দেখানো হয়—সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন কতটা জরুরি।
চলচ্চিত্রে অনেক ছোট ছোট বিষয় দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং এই বার্তা দেওয়া হয়েছে—শিশুদের পারিবারিক বন্ধন থেকে আলাদা করার সুযোগ নেই। এই বন্ধন আলগা হলেই শিশুর যেকোনো ক্ষতিকর বিষয়ের প্রতি আসক্তি বাড়ে।
তাই অভিভাবকদের সচেতন হওয়া জরুরি এবং খেয়াল রাখা জরুরি, যাতে তাদের শিশু অন্য কোনো ক্ষতিকর বিষয়ে আসক্ত না হয়।