প্রতিবেদন : মো. মামুন ইসলাম
রংপুর, ১৯ জুন, ২০২৫ (বাসস) : 'দাদা, শহীদি মৃত্যুই সর্বোত্তম। শহীদরা আল্লাহর নির্বাচিত বান্দা। তারা কোনো বিচার ছাড়াই জান্নাতে যাবে। তারা হলেন রহমানের মেহমান।' ২১ বছর বয়সী কুরআনের হাফেজ মো. নাসির ইসলাম জুলাই বিপ্লবে শহীদ হওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে তার দাদার কাছে কথাগুলো বলেছিলেন।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম প্রাণনাথে বসে বাসস প্রতিনিধির কাছে এসব স্মৃতি রোমন্থন করেন শহীদ নাসিরের ৭৬ বছর বয়সী দাদা মো. মকসেদ আলী।
গাজীপুর জেলার তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা (টঙ্গী শাখা)-র আলিম প্রথম বর্ষের ছাত্র হাফেজ নাসির ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু, মসজিদ-মাদ্রাসা-প্রিয় এক মেধাবী যুবক।
২০২৪ সালের ২০ জুলাই নিজের মাদ্রাসার সামনে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী বিশালবিক্ষোভে অংশ নিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। শহীদ হওয়ার এক দিন আগে আরেক শহীদ ছাত্রের জানাজায় অংশ নিয়ে সহপাঠীদের বলেছিলেন—'আল্লাহ চাইলে শহীদরা বিচার ছাড়াই জান্নাতে যায়।'
নাসির মানবসেবার জন্য একজন চিকিৎসক হতে এবং ইসলাম ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণী, বিশেষ করে শান্তির বার্তা, মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
নাসিরের বাবা মো. আশরাফুল ইসলাম সবসময় তাকে পরকালের কল্যাণের কথা ভাবতে বলতেন। সে তাই দুনিয়ার মোহে আকৃষ্ট না হয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে আল্লাহর নিয়ামতের প্রশংসা করত, নোংরামি অপছন্দ করত, এবং ধর্মীয় আলোচনায় আগ্রহী ছিল।
নাসির তার বাবা মো. আশরাফুল ইসলাম (৪৭) ও মা মোসাম্মৎ নাজমা আক্তারের (৩৭) একমাত্র ছেলে। তার দুই বোন আমিনা খাতুন (১৫) ও আছিয়া মনি (১২) গাজীপুরের কোনাবাড়ির মেট্রো স্কুল অ্যান্ড কলেজে যথাক্রমে নবম ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার ‘দ্য হাউজিং সোসাইটি’তে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া নাসির।
ছোটবেলা থেকেই মসজিদ ও মাদ্রাসার প্রতি ছিল তার আলাদা টান।
নাসিরের দাদা মো. মকসেদ আলীর পরিবার ছিল দারিদ্র্যপীড়িত। আট সন্তানের পিতা এই মানুষটি তার সন্তানদের প্রাথমিকের পর আর পড়াতে পারেননি। দাদি মোসাম্মৎ হামিদা বেগম (৬৫) গৃহিণী।
পারিবারিক দারিদ্র্েযর কারণে আশরাফুল ইসলাম ১৯৯৮ সালে রংপুর ছেড়ে গাজীপুরে গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। পরে ২০০১ সালে গার্মেন্টসে কর্মরত নাজমা আক্তারকে বিয়ে করেন।
আশরাফুল ২০০৭ সালে গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে নিজের ব্যবসা শুরু করেন। তখন নাসির প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মর্নিং সান হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়।
কিন্তু স্কুলে পড়াশোনা ভালো না লাগায় নাসির মাদ্রাসায় যতে চায়। কিন্তু অভিভাবকদের সম্মতি না পেয়ে সে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। চার মাস পর তার আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পেরে আশরাফুল তাকে তানজিমুল উম্মাহ হিফজ মাদরাসা, উত্তরা শাখায় ভর্তি করিয়ে দেন।
চার মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাকে সপ্তম শ্রেণিতে দুইবার রাখা হয়। ২০১৯ সালে হিফজ সম্পন্ন করে কুরআনের হাফেজ হয় নাসির।
এরপর তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে গাজীপুরের তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। ২০২২ সালে সে সেখান থেকে মেধার স্বাক্ষর রেখে দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং একই মাদরাসায় আলিম ক্লাসে ভর্তি হয়।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সে আলিম প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিল। সাত বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার পর দেশব্যাপী আন্দোলনের কারণে তার মাদ্রাসাও বন্ধ হয়ে যায়।
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে অস্থিরতা। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা—সর্বত্র ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার ও আওয়ামী লীগ বাহিনীর সশস্ত্র বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ও হামলা চালাতে থাকে।
এমন প্রেক্ষাপটে ২০ জুলাই বিকেলে তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার ছাত্ররাও মাদ্রাসার সামনে বিক্ষোভে অংশ নেয়। বিকেল ৩টার দিকে পুলিশ গুলি চালায়। একটি গুলি এসে নাসিরের বুকে লাগে এবং শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়।
বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে নাসিরের মোবাইল থেকে এক ব্যক্তি আশরাফুলকে ফোন দিয়ে জানায়, নাসিরকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
'আমি, আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও বড় ভাই আব্দুল আহাদ (৪৮)—একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ছুটে যাই। বিকেল ৬টায় পৌঁছাই। কিন্তু আমরা তার জীবিত মুখ আর দেখতে পাইনি,' বলেন আশরাফুল।
চিকিৎসকরা জানান, নাসিরকে তার সহপাঠীরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সে আরও ৩০ মিনিট বেঁচে ছিল এবং তখন তার রক্তের জরুরি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার তৎকালীন ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকারের নিষ্ঠুর নির্দেশনায় গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হয়।
'আমার ছেলেকে মৃত্যুর আগে সঠিক চিকিৎসাও দেওয়া হয়নি,' আশরাফুল কাঁদতে কাঁদতে বলেন।
হাসপাতালে তার মরদেহ নেওয়ার ক্ষেত্রেও পরিবারকে নানা হয়রানি সহ্য করতে হয়। সন্ধ্যা ৭টায় লাশ বুঝে পাওয়ার সময় একজন কর্মকর্তা লাশ ফের হাসপাতালে নিয়ে যান এবং বলেন, ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দেওয়া যাবে না।
রাত ১২টা ৫ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট থানার পুলিশ এসে লাশের সুরতহাল করে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।
পরদিন ২১ জুলাই ভোর সাড়ে ৩টায় লাশ বুঝে পায় পরিবার। অ্যাম্বুলেন্সে করে রাত ৭টায় গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে রওনা দিয়ে তারা রংপুরের প্রাণনাথ গ্রামে পৌঁছায় ২২ জুলাই ভোর ২টা ৩০ মিনিটে।
সকাল ৭টায় বাড়ির সামনে জানাজা শেষে ৭টা ৩০ মিনিটে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় নাসিরকে।
দাদা মকসেদ আলী বলেন, 'গত রমজানে নাসির বাড়ি এসে মসজিদে তারাবির জামাতে ইমামতি করে। তার সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়।'
বাড়িতে থাকলে সে দাদার সঙ্গে একই খাটে ঘুমাত এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নানা বিষয় ব্যাখ্যা করত।
নাসির একদিন বলেছিল, 'শহিদের মৃত্যুই শ্রেষ্ঠ মৃত্যু। শহিদরা বিচার ছাড়াই জান্নাতে যাবে। শহিদরা আল্লাহর অতিথি।'
তার শহিদ হওয়ার এক দিন আগে, আরেক শহীদের জানাজায় সহপাঠীদের বলেছিল, 'এই শহীদ জান্নাতি। আমরাও যদি শহীদ হতে পারতাম! আল্লাহ আমাদের শহীদি মৃত্যু দান করুন।'
মা নাজমা আক্তার বললেন, 'আমার একমাত্র ছেলে নাসির আল্লাহর অতিথি হয়ে জান্নাতে চলে গেছে। তার বাবার মতো আমিও গর্বিত। আমার শহীদ সন্তানের জন্য সবাই দোয়া করবেন।'