মোহাম্মদ জিগারুল ইসলাম
চট্টগ্রাম, ২৭ মে, ২০২৫ (বাসস) : চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী গরুর জাত ‘লাল বিরিষ’ (ষাঁড়) বা ‘রেড চিটাগাং ক্যাটেল’। চট্টগ্রামের মানুষের কাছে কোরবানিতে পছন্দের শীর্ষে।
এই লাল রঙের ষাঁড় গরুকে চট্টগ্রামের ভাষায় বিরিষ বলেন। আকারে ছোট হলেও গরুগুলো দেখতে সুন্দর ও সতেজ, তবে তুলনামূলক দাম একটু বেশি। এসব গরুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো লাল বর্ণের এবং এর মাংসের স্বাদ বেশি। প্রতি কোরবানি ঈদে চট্টগ্রামবাসীর প্রথম পছন্দের শীর্ষে থাকে এই লাল বিরিষ (ষাঁড়)।
তবে সবার পছন্দের এই গরু বাজারে মিলছে কম। দেশি-বিদেশি নানা জাতের গরুর ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের একমাত্র জাত রেড চিটাগাং ক্যাটেল। অসচেতনতার ফলে, এই জাতের সঙ্গে নানা জাতের বীজের সংকরায়ণের কারণে ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে অষ্টমুখী এই ‘লাল বিরিষ’।
এবারে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও ফটিকছড়িতে কিছু খামারি ও কৃষক ‘লাল বিরিষ’ মোটাতাজা করেছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ।
সুখবর হলো, চট্টগ্রামের বিশুদ্ধ এ জাতকে টিকিয়ে রাখার জন্য কয়েক বছর আগে থেকে কাজ শুরু করেছেন বাংলাদেশ প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট।
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আইডিএফ-এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় রেড চিটাগাং ক্যাটেলের (লাল বিরিষ) প্রদর্শনী খামার করা হয়েছে। এসব খামারের মাধ্যমে রেড চিটাগাং ক্যাটেলের বিশুদ্ধ প্রজনন ও জাতকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
জেলার ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশে বিভিন্ন হাট-বাজার ও খামার ঘুরে দেখা যায়, সংখ্যায় কম হলেও কোরবানীর পশুর হাটে এই জাতের গরু আসতে দেখা যাচ্ছে। পছন্দের শীর্ষে থাকায়, এ জাতের গরু মোটাতাজাকারীরা দামও পাচ্ছেন ভালো।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাট, যেমন- সাগরিকা, কর্ণফুলী, বিবিরহাট, আনোয়ারা সরকারহাট, রাঙ্গুনিয়ার গোডাউন বাজার, ফটিকছড়ির নাজিরহাট, মিরসরাই ও পটিয়া থানা হাটে কোরবানির সময় ‘লাল বিরিষ’ নিয়ে ক্রেতাদের অতি মাত্রায় আগ্রহ।
ক্রেতাদের অনেকেই সরাসরি খোঁজ করেন “লাল রঙের দেশি গরু আছে কিনা”।
দামও সাধারণ গরুর তুলনায় কিছুটা বেশি। তবুও সেই অতিরিক্ত টাকা দিতেও রাজি চট্টগ্রামের কোরবানি দাতারা।
সাতকানিয়া পৌরসভার খামারি আবদুল মান্নান বলেন, কোরবানি উপলক্ষে আমি মোট ২২টি গরু মোটাতাজা করেছি। এর মধ্যে ৫টি রেড চিটাগাং ক্যাটেল (লাল বিরিষ)। এই গরু দেখতে লাল ও সুন্দর হওয়ায় বাজারে সবার নজরে পড়ে। সারা দেশেই এই জাতের গরুর চাহিদা বেশি।
তিনি আরো বলেন, ৭ মাস আগে এই গরুগুলো বিভিন্ন বাজার থেকে কিনেছিলাম। এ সময়ের মধ্যে গরুগুলোর কোনো ধরনের রোগ হয়নি। খাবারও স্বাভাবিক। দেখতে অনেক সুন্দর ও মোটাতাজা হয়েছে। অন্যান্য যে কোন জাতের গরুর চেয়ে রেড চিটাগাং ক্যাটেল লালনপালন সহজ ও বাজারে তুলনামূলক ভাল দাম পাওয়া যায়।
রাউজানের কদলপুরের খামারি নূর হোসেন বলেন, লাল বিরিষের চাহিদা চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি। কোরবানির মাংসের স্বাদ যদি পূর্ণতা পায়, তা হয় মূলত এই লাল গরুর মাধ্যমেই।
তিনি আরো বলেন, এই বিশেষ ধরনের দেশি গরুর চাহিদা প্রতি কোরবানীর ঈদেই বেড়ে যায়। তবে ২০২৫ সালে যেন চাহিদা ছাপিয়ে তৈরি হয়েছে এক প্রকার প্রতিযোগিতা।
নূর হোসেন আরো বলেন, ঐতিহ্য, স্বাদ আর ‘লাল বিরিষ’-এর টানেই বাড়ছে কেনাবেচা। এই গরুর রং লাল, চর্বি কম, সুস্বাদু মাংস, লালন পালনে খরচ কম ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উচ্চ হওয়ায় এটি কোরবানির জন্য আদর্শ পছন্দ।
চট্টগ্রামের মেজবানি রান্নার বাবুর্চি মো. সাগর বলেন, চট্টগ্রামের রান্নার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে “লাল বিরিষ” নামের একটি অনন্য খাবার, যা তৈরি হয় গাঢ় লাল রঙা মসলা দিয়ে। এই রেসিপির মূল আকর্ষণ হলো- দেশি লাল গরুর মাংস।
তিনি আরো বলেন, স্থানীয়দের বিশ্বাস, লাল গরুর মাংস বেশি সুগন্ধি ও কোমল এবং রেসিপির জন্য লাল বিরিষ একেবারে উপযুক্ত। এবারের কোরবানীতে চট্টগ্রামে লাল গরু যেন শুধু কোরবানির পশু নয়, বরং একটি আবেগ, ঐতিহ্য আর রন্ধন-সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
সাতকানিয়া উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা, ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, রেড চিটাগাং ক্যাটেল হলো চট্টগ্রামের আদি ও একমাত্র জাত। এ জাতের গরুর রং, চোখ, চোখের ভ্রু, নাক, শিং, ক্ষুর, লেজ ও প্রজননঅঙ্গ লাল রঙের হয়। গরুর শিং তুলনামূলক ছোট ও পাতলা হয়। এ জাতের গরু দেখতে খুব সুন্দর ও শক্তিশালী হওয়ায় পছন্দের তালিকায় সবার শীর্ষে।
তিনি আরো বলেন, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে খামার ও কৃষকদের কাছে হাজারের অধিক রেড চিটাগাং ক্যাটেল (লাল বিরিষ) রয়েছে।
মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট রেড চিটাগাং ক্যাটেল উন্নয়ন ও সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সাতকানিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে কিছু প্রদর্শনী খামার করেছে।
তিনি বলেন, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আইডিএফ এসব প্রদর্শনী খামারের মাধ্যমে রেড চিটাগাং ক্যাটেলকে উৎপত্তিস্থল চট্টগ্রাম ও এর বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছে। তবে, গরুর খাদ্য, ওষুধ ও ভ্যাকসিনের দাম বৃদ্ধি এবং উন্নত গবেষণার অভাব খামারিদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রেড চিটাগাং ক্যাটেল দেখতে সুন্দর ও মাঝারি আকৃতির হয়। এ মাংসে চর্বি কম ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় কোরবানির জন্য এটি আমার প্রথম পছন্দ। এই গরুর মাংসে এক ধরনের ঘ্রাণ আছে, যেটা অন্য গরুতে পাওয়া যায় না।
তিনি আরো বলেন, ‘ঈদের দিনে আমরা চাই ঘরের সবাই মিলে খাওয়ার সময় যেন, সেই পুরোনো স্বাদের লাল বিরিষ ফিরে আসে। তাই প্রতি বছর লাল গরু খুঁজি, এ বছরও তার ব্যতিক্রম হবেনা।’
চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লাস্থ দস্তগীর হোটেলের মালিক আব্দুল জলিল বলেন, ‘আমাদের হোটেলের মেজবানীর মেনুতে আমরা আলাদা করে লাল গরু কিনে রাখি। কারণ কাস্টমাররা বিশেষ করে সেটাই চান।’