প্রতিবেদক: আল-আমিন শাহরিয়ার
ভোলা, ১৩ জুন ২০২৫ (বাসস): পবিত্র ঈদুল আজহা পালন শেষে কর্মস্থলমুখী মানুষ নৌ-পথ চলাচল করতে গিয়ে জীবন বাজী রাখছেন। জেলার অধিকাংশ এলাকা নৌযান নির্ভর হওয়ায় তাদের দুর্গতির কোনো শেষ নেই। এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত তাদের ছোট ছোট নৌকা ও ট্রলারে জোরপূর্বক যাত্রী তুলে উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিচ্ছে হরহামেশাই।
সরেজমিন দেখা যায়, ভোলা-বরিশাল-লক্ষ্মীপুর নৌ-রুটের নিষিদ্ধ ঘোষিত ডেঞ্জার জোনে আইন না মেনে প্রতিনিয়তই বিপুল যাত্রী নিয়ে চালানো হচ্ছে- ঝুঁকিপূর্ণ এসব নৌযান। এখানকার এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি বিভিন্ন রুটে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মেঘনা নদীর ডেঞ্জার জোনে ঝুঁকিপূর্ণ এসব নৌযান চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া এসব ছোট নৌযান মালিকদের লেলিয়ে দেয়া দুর্বৃত্তরা ঈদে কর্মস্থলে ফেরা মানুষকে জোরপূর্বক তাদের ট্রলারে উঠাতে বাধ্য করছে বলেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
কিছু অসাধু ব্যক্তির পেশীশক্তির কাছে জিম্মি থেকে প্রতিদিন বাধ্য হয়েই এসব নৌরুট দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল নদী পাড়ি দিচ্ছেন হাজারো মানুষ। ঝুঁকিপূর্ণ পারাপারের কারণে নৌ দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। এসব দুর্বৃত্ত চক্র নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ছোট ছোট লঞ্চ ও ট্রলারযোগে উত্তাল মেঘনা, তেতুলিয়া, কালাবাদর এবং বেতুয়া নদীতে যাত্রী পারাপার করছে হরদম। এতে করে যেকোনো সময় বড় ধরনের নৌ-দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন সাধারণ যাত্রীরা।
আজ শুক্রবার সকাল ১০ টায় ভোলা সদরের ইলিশা ফেরিঘাটে সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে গেলে কথা হয় ঈদ পরবর্তী কর্মস্থলে ফেরা চট্টগ্রামগামী যাত্রী আবুল হোসেন, আরিফ উদ্দীন, আশরাফ, জহুরা খাতুন ও জুবাইদা বেগমের সাথে। তারা সবাই সমস্বরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, প্রশাসনের দক্ষ তদারকির অভাবে ছোট লঞ্চ-ট্রলার ও স্পিডবোট মালিক চক্রের কাছে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি। এখানে আমাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নাই। ভোলার সবচেয়ে বড় এই নৌ-বন্দরের মতই এমন চিত্র এখন জেলার সাত উপজেলার প্রায় শতাধিক নৌঘাটে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরিশাল ও লক্ষ্মীপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার নদীপথে ১৫ মার্চ থেকে আগামী ৭ মাসের জন্য চলছে ডেঞ্জার জোন মৌসুম। এসময়টাতে এখানকার নদীপথ ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দূর্যোগে অশান্ত হয়ে ওঠে। উপকূলের এই নদীর বিশাল অংশে আগামী সাত মাস ছোট ও আনফিট লঞ্চগুলো চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিআইডব্লিউটিএ।
বিআইডব্লিউটিএ-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা চলাকালে এ অঞ্চলে বে-ক্রসিং সনদ (সমুদ্রে চলাচলযোগ্য নৌযান) ছাড়া অন্য কোনো নৌযান চলতে পারবে না। যে কারণে মেঘনা, তেঁতুলিয়া, ইলিশা, কালাবাদর ও বেতুয়ার মতো উত্তাল নদীগুলোতে ঝড়ের এ মৌসুমে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ-এর আওতাধীন নির্ভরযোগ্য নৌযান সি-ট্রাক চলাচলের কথা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দু'একটি সি-ট্রাক এখানকার নদীপথে চলাচল করলেও সরকারের অধিকাংশ জলযানগুলো ডকইয়ার্ডে। সেগুলো মেরামতের কাজ চলছে বলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কর্তৃক জানানো হয়েছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ১৫ মার্চ থেকে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত ৭ মাস ভোলার মেঘনা নদী সংলগ্ন ১৯০ কিলোমিটার এলাকাকে ডেঞ্জার জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সি-ট্রাক ছাড়া সব ধরনের অনিরাপদ নৌ যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এখানে। এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভোলা জেলার উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় চলছে ফিটনেস ও অনুমোদনহীন ছোট ছোট লঞ্চ ও ইঞ্জিন চালিত ট্রলার। দু'একটি রুটে সি-ট্রাক কিংবা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের ছাড়পত্রপ্রাপ্ত লঞ্চ থাকলেও বেশিরভাগ রুটেই এসব লঞ্চ না থাকায় ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে যাত্রীদের চলাচল করতে হচ্ছে।
বিশেষ করে ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীর হাট, দৌলতখান-মির্জাকালু থেকে চর জহিরুদ্দিন ও লক্ষ্মীপুরের আলেকজ্যান্ডার-রামগতি, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন থেকে মনপুরা এবং মুজিবনগর, কুকরী-মুকরী, ঢালচর,পটুয়াখালীর বাউফলসহ বিভিন্ন চরাঞ্চল ও উপ-দ্বীপগুলোতে চরম ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে যাতায়াতের দৃশ্য এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে।
এদিকে ভোলার সাথে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ হওয়ায় প্রয়োজনের তাগিদে নদী পথেই যাতায়াত করতে হয় যাত্রীদের। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক নিরাপদ লঞ্চ ও সি-ট্রাক নেই। তাই বাধ্য হয়ে যাত্রীরা হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে ঝুঁকিপূর্র্ণ ট্রলার, ইঞ্জিন নৌকা, ফিটনেস বিহীন ছোট ছোট লঞ্চে মেঘনা নদীর ডেঞ্জার জোন পাড়ি দিচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ ভোলা অঞ্চলের বন্দর কর্মকর্তা রিয়াদ হোসেন বাসসকে বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই অবৈধ নৌযানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। জরিমানা করছি। তবুও তারা বেপরোয়া। এখানে আমাদের জনবল সংকট না থাকলেও বিআইডব্লিউটিএ-এর নৌযান সংকট রয়েছে। নির্ভরযোগ্য নৌযান না থাকায় অসাধু নৌযানচক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে কোস্টগার্ডের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে বলেও জানান এ বন্দর কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে ভোলার জেলা প্রশাসক আজাদ জাহান বাসসকে বলেন, অনিরাপদ লঞ্চ চলাচল বন্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং অদক্ষ স্পিড বোট চালকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির আগেই ভোলার এসব ডেঞ্জার জোনে অবৈধ ও অনিরাপদ নৌযান এর বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার কথাও জানান তিনি।