ঢাকা, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : বিভোর নবম শ্রেণির ছাত্র। ক্লাসে বিভাগ নির্বাচনের সময় পরিবারের সকলে তাকে বিজ্ঞান অথবা বাণিজ্য বিভাগ নেওয়ার পরামর্শ দেয়। অথচ বিভোরের ইচ্ছে সে মানবিক বিভাগে পড়বে। কারণ মানবিক বিভাগের বিষয়গুলো তাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করে। পাশাপাশি তার প্রিয় গিটার শেখার জন্যে সে অনেকটা সময় বের করতে পারবে ভেবেও আনন্দিত হয়।
কিন্তু তার ইচ্ছের কথা জানালে পরিবারের সকলে, আত্মীয় স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের অনেকেই ভর্ৎসনা করতে থাকে। তারা বলে, মানবিক বিভাগে বাজে ছাত্ররা পড়ে। এখানে বেশি পড়ে মেয়েরা। মানবিক বিভাগে পড়ার কোনো ভবিষ্যৎ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিভোরের মন ভেঙে যায়। সকলের চাপে পড়ে পছন্দ অপছন্দের দ্বিধায় দুলতে থাকে সে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে অপছেন্দের বিষয় নিয়েই তাকে পড়া শুরু করতে হয়। এক পর্যায়ে প্রিয় গিটার শেখাটাও বন্ধ হয়ে যায় বিভোরের।
এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, এরকম আচরণের অন্যতম একটি কারণ শিশুর প্রতি মর্যাদাবোধের অভাব। শিশুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায় আস্থা রাখতে না পারাটা স্বাভাবিক চেহারা নিয়েছে আমাদের সমাজে। শিশু অধিকার নিয়ে পরিবারে অভিভাবক ও অন্যান্য সদস্য, স্কুলের শিক্ষক ও কর্মীবৃন্দ, পাড়া-প্রতিবেশী এবং সামাজিক ব্যক্তিবর্গের অজ্ঞতা ও অসচেতনতা রয়েছে। এর ফলে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে সন্তানের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নেয়া অনেকের পক্ষে প্রায়ই সম্ভব হয় না।
অথচ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, শিশুরা সর্বত্র কিছু মৌলিক অধিকার বৈষম্যহীনভাবে ভোগ করতে পারবে। এইসব অধিকারের প্রধান চারটি মূলনীতি হল-বেঁচে থাকার অধিকার; পূর্ণ মাত্রায় বিকাশের অধিকার; কুপ্রভাব, নির্যাতন ও শোষণ থেকে নিরাপদ থাকার অধিকার এবং পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে পুরোপুরি অংশগ্রহণের অধিকার।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’ সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন ও গ্রহণ করে। শিশু অধিকার সনদের খসড়া প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়নের সকল পর্যায়েই বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। প্রথম যে ক’টি সদস্য রাষ্ট্র এই সনদের মূল দলিলে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। বলা বাহুল্য, শিশু অধিকার সনদ ইতিহাসের সবচেয়ে সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল। ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশ জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদ অনুসমর্থন করে সনদের বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার করে।
এ প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ সম্পর্কিত বিষয়ে জানানো ও সচেতনতা তৈরি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আশার কথা, দেরিতে হলেও জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে শিশু অধিকার সনদের নানাবিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে শিশু অধিকার সনদের প্রেক্ষিতে শিশু নির্যাতন ও শোষণ প্রতিরোধেও কাজ চলছে। বিশেষ করে শিশুশ্রম ও শিশু পাচার প্রতিরোধে কাজ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা জোরদার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে শিশু অধিকার সনদে উল্লিখিত শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়ক অন্যান্য বিষয়গুলো তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত রয়ে গেছে। যেমন শিশুর বিনোদনের অধিকার বা তার মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি। শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই অধিকারগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটা বোঝার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নানা পর্যায়ে বড়দের সচেতনতার ঘাটতি রয়ে গেছে। যেকারণে শিশুকে পরিবার, স্কুল এবং সমাজের অন্যান্য জায়গায় নানারকমের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। বিভোরের বিষয়টি এর জলজ্যান্ত উদাহরণ।
বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে সরাসরি মানবাধিকার ও শিশু অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সে তুলনায় বেশ পরেই। এ কারণে যেসকল শিক্ষার্থী শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর সাথে যুক্ত, তারা ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই এই বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না। তবে বর্তমানে পাঠ্যসূচিতে থাকায় মানবাধিকার ও শিশু অধিকার নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার ও বিকাশের নানা বিষয় নিয়ে জানতে পারছে, প্রশ্ন করতে পারছে। যেমন পঞ্চম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইটিতে শিশু অধিকার ও মানবাধিকার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাঠ্যসূচিতে তুলে ধরা হয়েছে শিশুশ্রম, শিক্ষার অধিকার, শিশুদের যত্ন ও বিকাশের নানাদিক। বলা হয়েছে-জীবনধারণের অধিকার, সুরক্ষার অধিকার, শিক্ষা লাভের অধিকার, বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার না হওয়ার অধিকার এবং মত প্রকাশের অধিকার শিশুদের মৌলিক অধিকারের ভেতর পড়ে। তবে অধিকার বলতে কেবল পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্যের বিষয়টিই নয়,পাশাপাশি শিশুদেরও যে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করা গুরুত্বপূর্ণ সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি এবং দেশের প্রতি শিশুদের রয়েছে নির্দিষ্ট দায়িত্ব এবং কর্তব্য। সেগুলো পালন করার ভেতর দিয়ে শিশুরা তাদের জন্যে প্রদেয় সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বিকাশ নিশ্চিত করতে পারবে। পাঠ্যসূচিতে আরো বলা হয়েছে, শারীরিক নির্যাতন, শিশু পাচার, শিশুশ্রম এবং বাল্য বিবাহ চরমভাবে শিশুর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এসকল ক্ষতিকর বিষয় থেকে শিশুকে রক্ষার জন্যে প্রয়োজন শিশুদের প্রতি যত্নশীল হওয়া, শিশুদের সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা করা, শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা এবং শিশু অধিকার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা।
শিশুর বিকাশে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার যে গুরুত্বর্পূণ তাকে স্বীকার করে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়াটাও খুবই জরুরি। কারণ এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে শিশুর বিকাশ ও ব্যক্তিত্ববান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।