সুনামগঞ্জের হাওরে বিপন্ন দেশি মাছের প্রজন্ম 

বাসস
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:৫৮ আপডেট: : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:১১
ছবি: বাসস

মো. আমিনুল হক

সুনামগঞ্জ, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস): মাছ, পাথর, ধান সুনামগঞ্জের প্রাণ। এখানকার মানুষ ঘুম থেকে উঠেই পানির সঙ্গে মিতালি করে জীবন চালায়। হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জের হাওরে দেশি মাছের আকাল। বিপন্ন হয়েছে মাছের অনেক প্রজাতি। জেলা ও উপজেলার বাজারগুলো দখল করে রেখেছে পুকুর বা ঘেরে চাষ করা পাঙ্গাশ, শিং, মাগুর, তেলাপিয়া, কই ও কার্প জাতীয় মাছ।

মৎস্যজীবীরা জানান, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মাছ ধরার কারণে দেশীয় মাছের বংশ বিস্তার ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া বছর বছর হাওরে মাছের প্রজনন মৌসুমেও পানি না থাকা, বৃষ্টি না হওয়া, বিল শুকিয়ে মাছ ধরা এবং মা মাছ শিকার করায় দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তারে সংকট দেখা দিয়েছে।  

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার বালিকান্দি গ্রামের মৎস্যজীবী আব্দুর রহিম বলেন,  সুনামগঞ্জে দেশি মাছের আকাল কোনোভাবেই কাটছে না। প্রতিনিয়তই হাওরে যেন জোগান কমছে দেশি মাছের। বাজারে এখন শুধু পুকুর বা ঘেরে চাষ করা পাঙ্গাশ, শিং, মাগুর, তেলাপিয়া, কই ও কার্প মাছ। অন্য বছরের মতো মাছ চাষ না হওয়ায় মাছের দামও বেশি। 

তবে বৃষ্টি হলে দেশি মাছ পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন মৎস্যজীবীরা। এ সময় হাওর, খাল-বিল, নদী বাঘাইড়, রিটা, রানী পাঙ্গাশ, চিংড়িসহ নানা প্রজাতির দেশীয় মাছে ভরপুর থাকার কথা। তবে এসব মাছ এখন পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। 

মাছ ক্রেতা মামুনুর রশীদ জানান, এক সময় বাজারে হাওরের দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু, এখন চাষের মাছেই ভরসা। সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের হরিনাপাটি গ্রামের মৎস্য খামারি আব্দুল আলিম জানান, আমরা পানি ও বৃষ্টিপাত না হওয়ায় খামারেও সঠিকভাবে এইবার মাছ চাষ করতে পারছি না।

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে হাওরে নতুন পানি প্রবেশ করে। এ সময় মাছের প্রজনন মৌসুম শুরু হয়। মা মাছের ডিম ফুটে পোনা মাছ জন্ম নেয়। কিন্তু এবার পানি না থাকায় হাওরে মা মাছও নেই বলে জানান এ খামারি।

সুনামগঞ্জ মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, হাওরে একসময় দেশীয় প্রজাতির ১৪৩টি এবং ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে ৬৪ প্রজাতির মাছ হুমকির সম্মুখীন, ৯ প্রজাতির মাছ অতিবিপন্ন, ৩০ প্রজাতির মাছ বিপন্ন এবং ২৫ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। 

দেশের বৃহত্তম মিঠাপানির জলাধার সুনামগঞ্জে হাওর আছে ৯৫টি। ১০৫টি খাল ও নদী আছে ২৬টি। মোট বিল ও জলমহালের সংখ্যা ১ হাজার ৩৫টি। পুরো জেলায় জলাশয়ের মোট আয়তন ৬৩ হাজার ৬৬৬ হেক্টর। এর মধ্যে হাওরের আয়তন ৩৫ হাজার ৯৯০ হেক্টর এবং নদ-নদীর আয়তন ৬ হাজার ৬১ দশমিক ০৬ হেক্টর। জেলার উন্মুক্ত জলাশয়ে বছরে ৮৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং পুকুরে ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ মাছ উৎপাদন হয়। পুরো জেলায় বছরে মোট মাছের চাহিদা ৫৬ হাজার ৩৭২ টন। উৎপাদন হয় ১ লাখ ১৪ হাজার ১৩০ টন।

সুনামগঞ্জে নিবন্ধিত মৎস্যজীবী আছেন ১ লাখ ১ হাজার ৩২৯ জন এবং অনিবন্ধিত মৎস্যজীবী ২০ হাজার ৪১৪ জন। হাওরে মৎস্য সংকট থাকায় বেশির ভাগ মৎস্যজীবীই অন্য পেশায় চলে গেছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। 

জানা যায়, মহাশোল, সরপুঁটি, ঘারুয়া, বাঘাড়, রিঠা, চিতল, নাফতানি, বামোশ, রানী, চাকা, টাটকিনি, বাঁশপাতা, বাছা, ঢেলা, ফলি, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, তিতপুঁটি, কালিবাউস, নান্দিনা, খাশ খাইরা, তিলা শোল, শালবাইম, ঘাং মাগুর, নামা চান্দা, চিংড়ি, কাচকিসহ হরেক প্রজাতির মাছ বিপন্ন ও অতিবিপন্ন পর্যায়ে চলে গেছে।

অর্থাৎ, হুমকিতে আছে ৬৪ প্রজাতি, অতিবিপন্ন ৯, বিপন্ন ৩০, সংকটাপন্ন ২৫ প্রজাতির মাছ। পাশাপাশি সংকটে জল-জীবিকাও জলজ উদ্ভিগুলো বিলুপ্তির পথে। 

সুনামগঞ্জ মৎ সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি জহুর আলী বলেন, পানি না হওয়ার কারণে মাছ বংশ বিস্তার করতে পারছে না। প্রচণ্ড রোদও এর আরেকটি কারণ। আরেক দিকে বন্যার ভয়ে মানুষ ফিসারিতে আগের মতো মাছ চাষ করছে না। দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে, হাওরের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া। বালুতে ডোবা-বিল, জলাভূমি ও কৃষিজমি ভরাট হচ্ছে। 

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামশুল করিম জানান, সঠিক সময়ে হাওরে পানি না আসা, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাওরে দেশি প্রজাতির মাছের সংকট দেখা দিয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, গতবছরও মাছের যে বৈচিত্র্য দেখেছিলাম, এ বছর তাও দেখতে পাচ্ছি না। সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়া, নদ-নদী ভরাট, নির্বিচারে মৎস্য নিধন করার কারণে হাওরে দেশি মাছ কমছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত
ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩৬৩
বাংলাদেশ নারী হকি দলের দুই কান্ডারি সাতক্ষীরার রেহানা ও ষষ্ঠী
কোনো অজুহাতে নির্বাচন পেছানো যাবে না : মাসুক
ঢাবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ 
খুলনার কয়রা উপকূলে স্বাস্থ্য সেবায় সংকট নিরসনের দাবি 
মডেল মসজিদের নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ, নামাজ পড়তে পারছেন না মুসল্লিরা
বগুড়ায় জুলাই শহীদ স্মৃতি জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল রোববার শুরু
ঠাকুরগাঁও জেলা সিপিবির সম্মেলন অনুষ্ঠিত
ফ্রান্সের জাদুঘরে ৯৫ লাখ ইউরোর চীনামাটির বাসন চুরি
১০