আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল
চাঁদপুর, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : অনন্য ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান হলো পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল চাঁদপুরের তিন নদীর মোহনা। নদী বেষ্টিত এই শহর অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
চাঁদপুরের তিন নদীর মোহনায় ঢেউ, বাতাস আর নৌযান চলাচলের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় এক অপার সৌন্দর্যের দৃশ্য। ভোরবেলা কিংবা সূর্যাস্তের সময় সেই দৃশ্য হয় আরও মনোমুগ্ধকর। সূর্যের আলো নদীর পানিতে পড়ে ঝিলমিল করে। এর মধ্যে জেলেদের জাল ফেলার দৃশ্য যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্মের সৃষ্টি করে।
এই মোহনা বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের অন্যতম উৎস। বিশেষ করে ইলিশ মাছের জন্য চাঁদপুর বিখ্যাত। পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থলের স্রোতধারায় ইলিশের বিচরণ বেশি, তাই চাঁদপুরকে বলা হয় ‘ইলিশের বাড়ি’। প্রতি বছর বর্ষাকালে হাজারো জেলে নদীতে নামে ইলিশ ধরতে। আর এই ইলিশই চাঁদপুরের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।
তিন নদীর মোহনা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কেন্দ্র নয়, বরং ইতিহাস ও সংস্কৃতিরও ধারক। একসময় এই নদীপথ ছিল বাণিজ্য ও যাতায়াতের প্রধান রুট। পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার মিলনে গড়ে ওঠা অঞ্চল থেকেই দেশের অনেক অঞ্চলে পণ্য পরিবহন করা হতো। নদীপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলের দৃশ্য এখনো এই এলাকার ঐতিহ্য বহন করে চলছে।
পর্যটনের দিক থেকেও এই মোহনার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিদিনই শত শত মানুষ আসে চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশন বা মোহনা পয়েন্টে এই নদীর মিলনদৃশ্য উপভোগ করতে। এখানকার বাতাসে থাকে নদীর স্নিগ্ধতা, আর তীরের চা দোকানগুলো ভ্রমণপিপাসু মানুষদের গল্প আর হাসিতে মুখর করে তোলে। বিকেলে সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়ে, তখন মোহনার জলে লাল আভা পড়ে সে দৃশ্য একবার দেখলে ভুলে থাকা যায় না।
তিন নদীর মোহনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি এর রক্ষণাবেক্ষণও এখন সময়ের দাবি। নদীভাঙন, দূষণ ও অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। তাই প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ, যাতে প্রকৃতির এই অনন্য উপহারকে সংরক্ষণ করা যায়।
সব মিলিয়ে, চাঁদপুরের তিন নদীর মোহনা শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি বাংলাদেশের প্রাণ, ইতিহাস ও সৌন্দর্যের প্রতীক। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে যখন তিন দিক থেকে তিন নদীর স্রোত এসে মিশে যায়, তখন বোঝা যায়। বাংলাদেশের প্রকৃতি কতটা উদার, প্রাণবন্ত ও কবিতার মতো সুন্দর।
তিন নদীর মোহনাড ট্রলারচালক মেভ. এরশাদ মাঝি বলেন, এখানে তিন নদীর মোহনায় লোকজন বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘুরতে আসে, জায়গাটি পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। আমরা পর্যটকদের পদ্মার পশ্চিম পাড়ে মিনি কক্সবাজার নামে চর জেগেছে সেখানে ঘুরতে নিয়ে যাই। সেখানে গেলে আধঘণ্টা থাকলে ৫ শত টাকা আর ১ ঘণ্টা থাকলে ৬০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা নিই। প্রতিদিন কয়েকশ পর্যটক আসেন মোহনার স্রোত দেখতে।
মোহনায় ভ্রাম্যমাণ ফল বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন ঘুরতে আসে, তাদের কাছে আমি আনারকলি ফল বিক্রি করি। ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা করে। প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।
তিন নদীর মোহনায় পর্যটকদের টাকার বিনিময়ে ছবি তুলে দেন ক্যামেরাম্যান মো. সজিব হোসেন। তিনি জানান, বিগত তিন চার বছর ধরে তিন নদীর মোহনায় আগত পর্যটকদের ছবি তোলার কাজ করেন। একেকটি ছবি ৩ টাকা থেকে ৫ টাকা নিয়ে থাকেন। ২২ দিন প্রজননের জন্য এখন ইলিশ মাছ ধরা ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে সরকার, তাই পর্যটক কমেছে কিছুটা। আবার মাছ ধরা ও বিক্রি শুরু হলে পর্যটকদের ভিড় বেড়ে যাবে তিন নদীর মোহনায়।
হাজীগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা প্রদিপ পোদ্দার বলেন, তিনি মূলত ঢাকায় চাকরি করেন, তবে বাড়িতে আসলে বা চাঁদপুর আসলেই একবার ঘুরে যান তিন নদীর মোহনায়। তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান, মূলহেড থেকে মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্রে পর্যন্ত উন্নত বিশ্বের আদলে নদী শাসনের ব্যবস্থা করে ওয়াকওয়ে তৈরি করতে। এতে পর্যটক আরও বাড়বে।
চাঁদপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র মাছঘাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল বারি জমাদার মানিক বলেন, এই তিন নদীর মোহনা চাঁদপুরের একটি ঐতিহ্য। এখানে তিনটি নদী একত্রে মিলিত হয়েছে, এর সৌন্দর্য দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। এর স্রোতধরা বয়ে চলছে হাজার বছর ধরে।
চাঁদপুর পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিবের সঙ্গে কথা হয় পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে। তিনি বাসসকে জানান, আমাদের পুলিশের টিম সেখানে টহলে থাকে। তবে বিকেল থেকে রাতে তারা বেশি সময় ধরে পেট্রোলিং করে। পর্যটকদের কোনো অভিযোগ পেলে তারা তা তাৎক্ষণিক সমাধান করে।