
\ রেদ্ওয়ান আহমদ \
ঢাকা, ১ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুতই নিচে নামছে। ফলে পানিতে আর্সেনিকের ঘনত্ব বেড়ে বহু জেলায় তা নিরাপদ সীমা অতিক্রম করেছে। এতে খাবার ও সেচের পানির সংকট দেখা দিচ্ছে, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি সৃষ্টি করছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষক দেশের উৎপাদিত চাল ও সবজিতেও ক্ষতিকর মাত্রায় আর্সেনিক শনাক্ত করেছেন, যা মানবদেহে প্রবেশ করে লিভার ও কিডনির ভয়াবহ ক্ষতি করছে।
গত ১৪ জুন ’টক্সিকোলজি রিপোর্টস’ (এলসেভিয়ার) নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে এই তথ্য প্রকাশিত হয়। এর আগে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চলা এই গবেষণা বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের অর্থায়নে সম্পন্ন হয়েছে।
গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে চাঁদপুর জেলার দুটি আর্সেনিক-দূষিত উপজেলা হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তিতে। ওই এলাকার পানি, মাটি, চাল ও সবজি পরীক্ষা করে দেখা যায়, আর্সেনিক-দূষিত মাটি ও পানিতে উৎপন্ন চাল ও সবজি প্রাণীর দেহে এমন মাত্রায় বিষক্রিয়া ঘটায়, যা সরাসরি লিভার, কিডনি ও রক্তে ভয়াবহ ক্ষতির সৃষ্টি করছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, চাঁদপুর জেলা থেকে সংগৃহীত চাল ও সবজির (ঢেঁকি শাক, লাউ শাক, মানকচু) নমুনায় আর্সেনিকের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত সীমার তুলনায় বহুগুণ বেশি। পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ০.৩৭৩ মিলিগ্রাম, যা স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ সীমার (০.০১ মিলিগ্রাম/লিটার) প্রায় ৩০ গুণ বেশি। একইভাবে মাটিতে আর্সেনিকের সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল প্রতি কিলোগ্রামে ৩২.৫১ মিলিগ্রাম, যা বৈশ্বিক গড়ের (১০ মিলিগ্রাম/কেজি) প্রায় তিন গুণ। প্রতি কিলোগ্রাম চালে আর্সেনিকের মাত্রা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ০.৯১ মিলিগ্রাম, যা স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত নিরাপদ সীমার (০.৩৭ মিলিগ্রাম/কেজি) দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া, শাক-সবজির মধ্যে ঢেঁকি শাকে আর্সেনিকের মাত্রা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ১.৯৩ মিলিগ্রাম, যা বৈশ্বিক নিরাপদ সীমার (০.৫ মিলিগ্রাম/কেজি) প্রায় চার গুণ বেশি।
গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন চবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. লায়লা খালেদা। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-ফোরকান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাংশনাল জিনোমিক্স এন্ড প্রোটিওমিক্স ল্যাবরেটরির গবেষণা সহযোগী মো. মাজহারুল আলম এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রভাষক যারীন তাসনিমসহ আরও অনেকে। এছাড়া গবেষণা নমুনার টিস্যুবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান।
গবেষকরা ইঁদুর মডেলে আর্সেনিক দূষিত খাবারের প্রভাব পরীক্ষা করতে ছয়টি গ্রুপ তৈরি করেন। প্রথম গ্রুপে সাধারণ খাবার ও পানি দেওয়া হয়, যা ‘নেগেটিভ কন্ট্রোল’। দ্বিতীয় গ্রুপে সাধারণ খাবারের সঙ্গে সোডিয়াম আর্সেনাইট দেওয়া হয়, যা ‘পজিটিভ কন্ট্রোল’। তৃতীয় ও চতুর্থ গ্রুপে যথাক্রমে আর্সেনিকমুক্ত এবং আর্সেনিক-দূষিত চাল প্রদান করা হয়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ গ্রুপে আর্সেনিকমুক্ত ও আর্সেনিক-দূষিত ঢেঁকি শাক দেওয়া হয়। এইভাবে ছয়টি গ্রুপের মাধ্যমে গবেষকরা আর্সেনিক দূষিত খাবারের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে এর সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি মূল্যায়ন করেন।
আর্সেনিক-দূষিত চাল ও সবজি উইস্টার অ্যালবিনো ইঁদুরের খাদ্যে ব্যবহারের ১২০ দিনের মধ্যে দেখা গেছে, পর্যায়ক্রমে ইঁদুরের স্বাভাবিক খাবার গ্রহণের প্রবণতা কমে গেছে এবং দেহের ওজন হ্রাস পেয়েছে। নমুনা পরীক্ষায় আরো দেখা গেছে, প্রাণীর রক্তে হিমোগ্লোবিন, লোহিত ও শ্বেত রক্ত কণিকা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যা অ্যানিমিয়া ও দুর্বল ইমিউন সিস্টেমকে নির্দেশ করে। লিভার এনজাইম (অ্যাএলটি, অ্যাএসটি) ও কিডনি সূচক (ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন) বেড়েছে, যা অঙ্গ বিকলতার লক্ষণ।
টিস্যু পরীক্ষায় (হিস্টোপ্যাথলজি) লিভার ও কিডনির কোষ ক্ষয় পরিলক্ষিত হয়েছে, সেই সাথে কোষে ফ্যাট জমা ও প্রদাহের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এই ফলাফলগুলো ইঙ্গিত দেয়, নিয়মিত আর্সেনিক দূষিত খাবার গ্রহণ করলে মানুষের ক্ষেত্রেও একই রকম দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি, অর্থাৎ লিভার, কিডনি কিংবা অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে।
গবেষকদের দাবি, বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ নতুন কিছু নয়। গত দুই দশকে বহু গবেষক দেশের বিভিন্ন জেলার চাল, সবজি, মাটি ও পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি রিপোর্ট করেছেন। খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে আর্সেনিক কিভাবে জীবদেহে প্রবেশ করে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ আগে পাওয়া যায়নি। তারা বলছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা মূলত বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত প্রথম বৈজ্ঞানিক কাজ, যেখানে প্রাকৃতিকভাবে দূষিত চাল ও সবজি প্রাণীর খাদ্যে ব্যবহার করে এর ক্ষতিকর প্রভাব দেখা হয়েছে।
এ বিষয়ে গবেষণা সহযোগী মো. মাজহারুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে এতদিন আর্সেনিক দূষণকে মূলত পানীয় জলের সমস্যা হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এই গবেষণায় আমরা দেখিয়েছি, প্রতিদিনের খাদ্যও এখন এই আর্সেনিকের নীরব বিষের বাহক। তাই, এখনই জাতীয় পর্যায়ে খাদ্যশস্যে আর্সেনিকের মাত্রা পর্যবেক্ষণ চালু করা জরুরি। নয়তো ভবিষ্যতে লিভার, কিডনি ও ক্যান্সারসহ দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে।’
প্রভাষক যারীন তাসনিম বলেন, ‘আমরা দেখেছি আমাদের প্রতিদিনের খাবার আর্সেনিক-দূষিত মাটি ও পানিতে জন্মানোর মাধ্যমে অজান্তেই নীরব ঘাতক হিসেবে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে, যা শিশু, নারী ও বয়স্কদের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ফেলছে।’
অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় প্রথমবারের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশে আর্সেনিক দ্বারা দূষিত খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে প্রাণীর টিস্যু স্তরে এর সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এটি এই গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, কারণ বাস্তব পরিস্থিতিতে মানুষ বা প্রাণী যেভাবে খাদ্যের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে আর্সেনিকের সংস্পর্শে আসে, সেটিই আমরা পরীক্ষামূলকভাবে দেখাতে চেষ্টা করেছি।’
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-ফোরকান বলেন, ‘এই গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি আমাদের দেশের বাস্তব সমস্যাকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রমাণ করেছে। আমরা দেখেছি, আর্সেনিক দূষিত সেচের পানি কৃষিজ মাটিতে গিয়ে সেখানে উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এটি শুধু একটি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য স্পষ্ট সতর্কবার্তা।’
গবেষণা প্রধান অধ্যাপক ড. লায়লা খালেদা বলেন, ‘বাংলাদেশে এর আগেও অনেক গবেষণায় চাল ও সবজিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলো মূলত আর্সেনিকের পরিমাণ শনাক্তকরনেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিলো খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে আসা আর্সেনিক দূষিত খাদ্যশস্যের প্রকৃত জৈবিক প্রবণতা প্রাণীর শরীরে কতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাই করা। গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিকযুক্ত চাল ও সবজি কিছু মাস খাওয়ানোর পর ইঁদুরের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায় এবং যকৃত ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আর্সেনিকের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, কিডনি ফেইলিওর, লিভার সিরোসিস, চর্মরোগ ও অন্যান্য ক্রনিক রোগের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন প্রয়োজন একটি জাতীয় মনিটরিং সেল চালু করা। যার মাধ্যমে সেচের পানি, মাটি এবং খাদ্যশস্য নিয়মিত পরীক্ষার আওতায় আনা যাবে। আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নেই, আর্সেনিক দূষণ দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন রোগের মাধ্যমে পুরো জাতির স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত অবিলম্বে খাদ্যশস্যে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা পরীক্ষণ শুরু করা।’