শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন হাবিবুল বাদশা। তিনি জীবন দেননি ঠিকই। কিন্তু এখন তাকে অভাব অনটন আর পঙ্গুত্বের ভারে অনেকটা অর্ধমৃত জীবন কাটাতে হচ্ছে।
আন্দোলনকালে হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলিতে পা হারাতে বসেছেন হাবিবুল বাদশা (১৮)। পায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাদশার পরিবারকে করতে হয়েছে প্রায় লাখ টাকা ঋণ।
একদিকে সন্তানের ভবিষ্যত এবং অন্যদিকে ঋণ পরিশোধের চিন্তা এসব নিয়ে দিশাহীন তার বাবা-মা।
বাদশা বলেন, ‘প্রথম দিনই (২০ জুলাই) শুধু অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া লেগেছে ১৫ হাজার টাকা। চিকিৎসা করাতে প্রায় দেড় লাখের মতো খরচ হয়ে গেছে। আমার চিকিৎসার জন্য মা এলাকা থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। লোকজনের কাছ থেকেও কিছু টাকা ধার করা হয়েছে। সরকার থেকে পেয়েছি ১ লাখ টাকা। সরকার যে টাকা দিয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি টাকা খরচ হয়েছে আমার পরিবারের। কিন্তু আমরা পা ভালো হবে কি না তা নিয়েও এখনও সংশয় রয়েছে। আবার ঋণের টাকা পরিশোধ কিভাবে করা হবে এ নিয়েও আব্বু- আম্মু খুব চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।’
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই রাজধানীর চিটাগাং রোডের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলি লাগে বাদশার পায়ে। এতে গুরুতর জখম হয় তার ডান পা।
সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের শয্যায় বসে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আহত হাবিবুল বাদশার।
তিনি বলেন, ‘গুলি লাগার পর থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের যে হাসপাতালে ছিলাম, সেখানে চিকিৎসা করাতে প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন চিকিৎসা সরকারিভাবে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পরিবারের সদস্যদের আসা-যাওয়া ও খাওয়ার খরচ আছে না? আমার বাবা গরিব মানুষ, তিনি সিএনজি চালান। তিনি টাকা পাবেন কোথায়?’
হাবিবুল বাদশা সিলেটের সদর উপজেলার ছড়ারপাড় এলাকার মানিক মিয়ার (৪৬) ছেলে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে বাদশা সবার বড়। তিনি সিলেট এমসি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আহত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার লেখাপড়া বন্ধ। মা রাবেয়া বেগম (৪১) গৃহিণী। বাদশার ছোট দুই ভাই রাজা পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে এবং রানা পঞ্চম শ্রেণিতে। সবার ছোট বোন এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। বাবা সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। তার একার আয়ে চলে সংসার।
সরকারের কাছে একটি চাকুরির প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, ‘সরকার যদি চাকরির ব্যবস্থা না করে বা পরিবারের দিকে না তাকায়, তাহলে অবস্থা শোচনীয় হয়ে যাবে। আমার দাবি, সরকার যেন আমাদের কোনো একটা ব্যবস্থা করে দেয়।’
‘ভবিষ্যতে কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল আপনার’ এমন প্রশ্ন করতেই বাদশার দুই চোখ পানিতে ভিজে যায়। কান্না করতে শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেন আমার স্বপ্ন আর পূরণ হবে না। আমাকে পরিবারের বোঝা হয়েই বেঁচে থাকতে হবে।
কিছু সময় পরে আবার কান্না করতে করতে হাবিবুল বাদশা বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল অনেক বড় ক্রিকেটার হবো। আমি সিলেট জেলা ক্রিকেটের আন্ডার এইটটিন টিমে খেলতাম। আন্ডার এইটটিনে প্লেয়ার ছিলাম, অলরাউন্ডার। আশায় ছিলাম এ বছর আমি বিকেএসপিতে ভর্তি হবো। তবে তা আর হল না। আর কোন দিন হবেও না।’
তিনি বলেন, আমি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হই। এখন আর আগের মতো দৌঁড়াতে পারবো না। ভারি কিছু তুলতে পারবো না। খেলবো কি ভাবে।
তারপরও আমি স্বপ্ন দেখি ক্রিকেটার হওয়ার। অনেকেই আমাকে আশা দেখাচ্ছেন মাশরাফির মতো! মাশরাফি যেমন ভাঙা পা নিয়ে খেলেছেন, তারা বলেন, তুমিও হয়তো পারবে সে রকম করে খেলতে। আবার মাঠে ফিরতে পারবে, আগের মত ব্যাট হাতে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু আসলে বাস্তবতা তো আমি বুঝি, আমার কি হবে।
আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বাদশা জানান, তার খালার বাসা চিটাগাং রোড়ের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়। সে সময়ে তিনি গিয়েছিলেন খালার বাসায় বেড়াতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কথা। তারপর যুক্ত হয়ে পড়েন আন্দোলনে। আর সিলেটে ফেরেননি। কারণ বাড়িতে গেলে মা-বাবা আন্দোলনে যুক্ত হতে দেবেন না। ১৫ জুলাই থেকে আন্দোলনে যুক্ত হন। ২০ জুলাই আন্দোলন করছিলেন চিটাগাং রোডের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়। সেদিন বেলা ২টার দিকে আন্দোলনে নামেন।
তিনি বলেন, ‘হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হচ্ছিল। পুলিশ-র্যাব-বিজিবি বিভিন্ন জায়গা থেকে গুলি চালাচ্ছিল। বিজিবি গুলি চালাচ্ছিল হীরাঝিলের রাস্তার মুখ থেকে। সেখান থেকে আমাদের ধাওয়া দেয়। তখন আমরা অবস্থান নেই কাঠের পুল এলাকায়। বিকেল ৪টার দিকে হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলি আমার পায়ে লাগে। সেখানে চোখের সামনে আমার দুই বন্ধু গুলি লেগে মারা যায়।’
বাদশা জানান, তার পায়ে গুলি লাগার পর কয়েকজন তাকে ধরে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে তাকে চিকিৎসা দেয়নি। খানপুরে একটি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে ড্রেসিং করে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার পায়ের ভেতরে গুলি ছিল না। ডান পায়ের এক পাশ থেকে গুলি ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেলে আসার পর আবার ড্রেসিং করে তাকে রিলিজ দেওয়া হয়। ওই দিনই চলে যান খালার বাসায়। তারপর সিদ্ধিরগঞ্জে একটি হাসপাতালে প্রায় এক মাস চিকিৎসা নেন। সেখানে অনেক বেশি টাকা ব্যয় হচ্ছিল। তাই সরকার পতনের পর চলে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
গত ২২ আগস্ট এসে ঢাকা মেডিকেলের অর্থোপেডিকস বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে রেফার করা হয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে। বাদশার মা-বাবা পরিবারের সবাই সিলেটে থাকেন। হাসপাতালে সঙ্গে রয়েছেন তার দাদি আমেনা খাতুন (৬৫)। মাঝে মাঝে খালা আর এক ফুফু আসতেন দেখতে। খালা একটা চাকরিতে যোগদান করায় এখন আসতে পারেন না।
আহত বাদশা বলেন, ‘আগের মতো স্বাভাবিকভাবে আর চলাচল করতে পারব না। আমার পায়ের যেখানে গুলি লেগেছে সেখানকার হাড়টা নেই। ধীরে ধীরে হাড়টা বৃদ্ধি পাবে। তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ভারি কিছু তুলতে পারব না। মোটামুটি একটা পর্যায়ে যেতে ছয় মাসের বেশি লেগে যাবে।’
তিনি বলেন, বর্তমানে কিছুটা মানসিক সমস্যা হচ্ছে। মাঝে মাঝে পেছনের কথা মনে পড়ছে না। হাসপাতালে আরও বেশ কয়েক দিন থাকা লাগতে পারে। আরেকটা অপারেশন হবে।
বাদশার দাদি আমেনা খাতুন বলেন, নাতিটার অনেক ইচ্ছা ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। কিন্তু তা আর হলো না। ওর ঘরে অনেক পুরস্কার রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় খেলে পুরস্কার জিতেছে। আমার নাতির জন্য দোয়া করবেন ও যেন সুস্থ হয়ে যায়। আবার মাঠে নেমে খেলতে পারে। ওর বাবার সিএনজি চালায়। অনেক কষ্ট করে সংসার চালায়, বাদশার চিকিসা করাতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে।
বাদশার চিকিৎসার বিষয়ে ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, বাদশার পায়ে গুলি একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। তার পায়ের মাঝখানে গুলি লাগায় হাড় ভেঙ্গে গেছে। আস্তে আস্তে হাড় বড় হয়ে ভাঙ্গা স্থানটা পূরণ হতে ছয় মাসের বেশি সময় লাগবে। পা মোটামুটি ভালো হলেও সে ভারি কোন কাজ করতে পারবে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি।