প্রতিবেদন : আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল
চাঁদপুর, ১৮ জুন, ২০২৫ (বাসস) : শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আব্দুল্লাহ কবির। নিজের একমাত্র ছেলেকে হাফেজে কোরআন বানানোর ইচ্ছে ছিল তার। সে ইচ্ছা পূরণ হওয়ার আগেই পরপারে চলে গেলেন তিনি।
৪৫টি রাজনৈতিক মামলা মাথায় নিয়েও একেবারে শুরু থেকেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন আব্দুল্লাহ কবির। ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ১৫ বছরে এসব মামলা দায়ের হয়।
মামলার কারণে ১৫ বছর ধরে পলাতক জীবনযাপন করতে হয়েছে তাকে। নিজ বাড়িতে থাকতে না পেরে তাকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থেকে গোপনীয়তা রক্ষা করে জীবন যাপন করতে হয়েছে।সর্বশেষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ১১ নং ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন বলে জানান তার ছোট ভাই রাজু।
সম্প্রতি সরেজিমন শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের নানা বাড়ি সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নের দক্ষিণ হামানকর্দি খাসের বাড়িতে যান বাসস প্রতিবেদক। সেখানে সমাহিত করা হয়েছে শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরকে।
মো. আব্দুল্লাহ কবির (৪৫)-এর জন্ম ১৯৭৮ সালের ১১ নভেম্বর। তার বাবা মরহুম মোসলেহ উদ্দিন খান, মা মোসাম্মৎ সুরাইয়া বেগম (৭২)। ৪ বোন ও দুই ভায়ের মধ্যে কবির ছিলেন চতুর্থ। তার বোনেরা হলেন- রত্না বেগম (৫৫), হীরা বেগম (৫০) মুক্তা বেগম (৪৮), রুমি (৪২)। আর ছোট ভাই গাউসুল্লাহ রাজু (৪০)। শহীদ কবিরের ৪ বোন গৃহীনি। একমাত্র ছোট ভাই মিরপুরে গার্মেন্টস পণ্য স্টকলটের ব্যবসা করেন।
শহীদ কবিরের জন্ম স্থান চাঁদপুরের মতলব পৌরসভার বড়দিয়া আড়ং গ্রামের খান বাড়ি। তবে নদী ভাঙনে বসতবাড়ি বিলীন হওয়ায় তাদের বর্তমান ঠিকানা রাজধানীর মিরপুর মধ্য পাইকপাড়ার গবেষণাগার সড়কের ১০৭ নম্বর বাড়ি।
শহীদ আব্দুল্লাহ কবির ১৯৯৩ সালে ঢাকার ধামরাই স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৯৫ সালে মিরপুর কমার্শিয়াল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৯৬ সালে ঢাকা মোহাম্মদপুর নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজে স্নাতকে ভর্তি হয়ে কিছুদিন পর ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ও একমাত্র ছোট ভাই মিরপুরে গার্মেন্টস পণ্য স্টকলটের ব্যবসা করতেন।
কবিরের স্ত্রী আফসানা আক্তার (৪০)। পেশায় তিনি গৃহিণী। শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ। শহীদ আব্দুুল্লাহ কবিরের সাথে আফসানার বিয়ে হয় ২০১২ সালে। তাদের একমাত্র সন্তান আহনাফ খান (৯), স্থানীয় মারকাজুল ফয়েজুল কুরআন আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসায় হিফজুল কুরআন বিভাগে পড়ে।
আফসানার বাবার বাড়ি মতলব দক্ষিণ উপজেলার সদরের কলাদি টিএন্ডটি মোড় এলাকায়। তার বাবার নাম আলী আজম। মায়ের নাম মায়া নুর। আফসানার তিন ভাইয়ের মধ্যে দুজন বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন এবং একজন মতলব বাজারে ব্যবসা করেন।
শহীদ কবিরের ছোট ভাই গাউসুল্লাহ রাজু বলেন, ঘটনার দিন ৪ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে তিনি ব্যবসায়ী লেনদেনের জন্য ব্যাংকে যান। সেখান থেকে সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি আন্দোলনরত অবস্থায় ছিলেন। আন্দোলনের মধ্যে যখন গুলি চালানো হচ্ছিল তখন একাধিক টেলিভিশন আন্দোলনের ঘটনা লাইভে প্রচার করছিল।
তিনি বলেন, বেলা আড়াইটার দিকে আমার ভাবির মোবাইলে ভাইয়ের ফোন থেকে কল আসে। তাকে ম্যাক্স হাসপাতালে যেতে বলা হয়। আমার ভাবি তৎক্ষণাৎ সেখানে যান। তবে পুলিশের বাধার মুখে ওই হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে না পেরে চলে যান ইসলামিয়া হাসপাতালে। সেখানেও চিকিৎসা না পেয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কুর্মিটলা জেনারেল হাসপাতালে। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভাইয়ের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়না তদন্ত করতে বলে। কিন্তু আন্দোলন ও ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ লাশ নেয়নি। সবশেষ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের খবরের পর বেলা ২টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশ আমাদের ডেকে এবং ছাড়পত্র দিয়ে মরদেহ হস্তান্তর করে।
ওই দিন রাতেই রওয়ানা দিয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নের দক্ষিণ হামানকার্দি গ্রামে নানা বাড়িতে নিয়ে আসি। কারণ তখন দেশে আন্দোলনের কারণে আমার মা ঢাকা না থেকে নানা বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। মায়ের অনুরোধে পরদিন ৬ আগষ্ট সকালে নামাজে জানাযা শেষে নানা বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে ভাইকে দাফন করা হয়।
এই ঘটনায় শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের স্ত্রী আফসানা আক্তার গেল বছরের ১৯ আগস্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন। আবেদনটি বিচারক আমলে নিয়ে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এজহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য নির্দেশন দেন। ওই মামলায় বাদী ৬৮জনকে নামীয় আসামি করে মামলা করেন। মামলার সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের স্ত্রী, মা,ভাইসহ পরিবারের সদস্যরা।
শহীদ কবিরের ছোট ভাই গাউসুল্লাহ রাজু আরো বলেন, আমার ভাইয়ের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে সব সময় হয়রানির শিকার হন। তিনি ৪০ থেকে ৪৫টি রাজনৈতিক মামলার আসামী ছিলেন। ভাইকে আমাদের ব্যবসায়ীক ঠিকানায় না পেয়ে পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে যায়।
প্রথম বার ২০১৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ নিয়ে গেলে দেড় মাস এবং ২০১৫ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে গেলে সাড়ে ৭ মাস কারাভোগ করতে হয়। তবে আমি কোন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী না। আমি ভাইয়ের এমন মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।
শহীদ কবিরের স্ত্রী আফসানা আক্তার বলেন, ২০১২ সালে আমার সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে আমি দেখি তিনি মামলার কারণে ঠিকমত নিজ বাড়িতে থাকতে পারেন না। বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে থাকেন এবং পরিবারের সদস্যদেরও সময় দিতে পারেন না।
তিনি যেদিন শহীদ হন, সেদিন তার গায়ে ১০২ ডিগ্রি জ্বর ছিল। আমি উনাকে নিষেধ করা সত্ত্বেও আমার কথা শুনেননি। তিনি এইভাবে আন্দোলনে গিয়ে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হলে আমাদের কী হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখার কথা বলেন এবং ছেলেকে হাফেজে কোরআন বানানোর জন্য বলে যান। ছেলেটাকে হাফেজে কোরআন বানাবেন এটা উনার স্বপ্ন ছিল।
তিনি আরো বলেন, স্বামী শহীদ হওয়ার পর তার ব্যবসা বন্ধ। তিনি সন্তানকে নিয়ে দারুস্সালাম এলাকায় বর্ধন বাড়ি (বাড়ি নং-৪৮) ভাড়া থাকেন। কিন্তু এখন খুবই অর্থ কষ্টে আছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হলে সন্তানকে নিয়ে কোনো রকম বেঁচে থাকতে পারবেন বলে জানান তিনি।
আফসানা আক্তার বলেন, এই পর্যন্ত সরকারি অনুদান হিসেবে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৪ লাখ টাকা (শাশুড়ি ১ লাখ টাকা) পেয়েছেন। এছাড়া ঢাকায় জামায়াতের পক্ষ থেকে ২লাখ টাকা এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন।
ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আবেদন করেছেন, সেখান থেকে এখন পর্যন্ত কোন অনুদান পাওয়া যায়নি। চাঁদপুর জেলার ঠিকানায় আব্দুল্লাহ কবিরের নাম গ্যাজেটে ৫৬ নম্বরে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
শহীদ কবিরের ছোট বোন রুবি থাকেন মিরপুর পাইকপাড়া এলাকায়। শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের মা সুরাইয়া বেগম সেখানে তার সাথে থাকেন। রুবি বলেন, ভাই শহীদ হওয়ার পর থেকে ভাবি আলাদা থাকছেন। ভাই মায়ের চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচ দিতেন। তা এখন বন্ধ হয়ে আছে। আমি পরের ঘরে থাকি। এই অবস্থায় মাকে তার চাহিদা মতো সহযোগিতা করা সম্ভব হয় না।
শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের মা সুরাইয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ৩০ ও ৩১ জুলাই ছেলের সাথে আমার কথা হয়। আন্দোলনের সময় ছেলের সাথের লোকজন গুলিবিদ্ধ হয়। এসব খবর শুনে আমার খুবই মন খারাপ হয়। তখন থেকে ছেলেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করি। কিন্তু সে আমাদের কারো নিষেধ শুনে নাই। আন্দোলনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারায়।
তিনি বলেন, আমার অন্য সন্তানের চাইতে কবিরই বেশি খোঁজ-খবর রাখত। আমার ছেলে রাজনৈতিক মামলার কারণে ঠিকমত বাড়িতে থাকতে পারেনি। তারপরও গোপনে এসে আমার খোঁজ-খবর নিত এবং আমার ওষুধ কিনে দিত। ছেলেকে হারিয়ে আমি এখন খুবই অসহায়। আজ কয়মাস আর আমার বাপরে দেখি না, আমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসে না।
তিনি বলেন, এখন আমার নিজের চলার মত অবস্থা নেই, তাই আমার ও আমার নাতি ও ছেলের বউয়ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চাই।