খুলনা, ১৯ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার একটি এলপিগ্যাস দোকানে ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করতেন ১৭ বছরের কিশোর ইয়াসিন শেখ। ২১ জুলাই জাতীয় কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৫ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
সেই দিনটির কথা স্মরণ করে ইয়াসিনের মা বলেন, ‘একটা অজানা নাম্বার থেকে ফোন আসে, বলে আমার ছেলেকে গুলি করা হয়েছে। ইয়াসিনের বুকে তিনটা গুলি লেগেছে, সে রাস্তায় পড়ে আছে।’
মনজিলা বেগম বলেন, ‘খবর পেয়ে আমি দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা ধার করে তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি।’
থানায় কোনো মামলা করেছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মনজিলা বেগম বলেন, ‘থানায় মামলা করে কী হবে? আমার সন্তান কি ফিরে আসবে? আমরা গরিব মানুষ। আমার ছেলে কোনো রাজনৈতিক দলে ছিল না। কিন্তু সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করত।’
শহীদ ইয়াসিন শেখের মা মনজিলা বেগম কাঁপা কণ্ঠে বলেন, ‘এখন আমি কাকে নিয়ে বাঁচব? কীভাবে চলব আমরা?’
ইয়াসিনের জীবনটা ছিল সংগ্রামের। যখন তার বয়স মাত্র দুই বছর, তখনই বাবাকে হারান তিনি। এরপর মা মনজিলা বেগম ও দুই ছোট বোনকে নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে বসবাস শুরু করেন।
বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে প্রাথমিক শিক্ষার পর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি ইয়াসিন। মা কাগজের কারখানায় কাজ করে সংসার চালাতেন। যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি ছোট ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলেন ইয়াসিন। খুবই কম বেতনে গ্যাস ডেলিভারির কাজ করতেন। তার আয়ে মা ও দুই বোনের সংসার চলত।
মনজিলা বেগম বলেন, ‘২৬ জুলাই খুলনার রূপসা উপজেলার পারিবারিক কবরস্থানে গ্রামের লোকজনের সহায়তায় আমার ইয়াসিনকে দাফন করি। গ্রামের মানুষ অটোপসি ও দাফনের খরচের জন্য অল্প টাকা তুলে দিয়েছেন।’
বাসসকে ইয়াসিনের বড় বোন নূরজাহান বলেন, ‘আমার ভাইকে বুকে তিনটি গুলি করা হয়েছিল। ডাক্তাররা দুটি গুলি বের করতে পারলেও অবস্থার অবনতি হওয়ায় তৃতীয় গুলিটি শরীরেই থেকে যায় এবং সে মারা যায়।’
নূরজাহান বলেন, ‘আমরা তিন বোনের একমাত্র ভাই ছিল ইয়াসিন। যখন শুনলাম ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, তখন ভাইকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। কিন্তু পরে শুনলাম পুলিশ তাকে গুলি করেছে। মা এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি।’
উল্লেখ্য, সাধারণ ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার যৌক্তিকভাবে বিষয়টির সমাধান না করে ছাত্রলীগকে দিয়ে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিল।
একইসঙ্গে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে আন্দোলন দমন করতে সক্রিয় হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে বুক পেতে শহীদ হন। এতে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ওই দিন সারা দেশে আরও ছয়জন নিহত হন।
ক্রমে আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগের এক দফায় রূপ নেয়। এ আন্দোলন দমন করতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হন। পাল্টা হামলায় বেশ কিছু পুলিশ সদস্যও নিহত হন। হাজার হাজার মানুষ গুলিবিদ্ধ হন।
পরিশেষে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। পরে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে।