প্রতিবেদন : ওবাইদুর রহমান
ঢাকা, ২১ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ‘যারা আন্দোলন করছে, তারাও আমাদের মতো মা-বাবার সন্তান। তারা আন্দোলন করছে, যেন তাদের চাকরির কোনো সমস্যা না হয়। আমাদেরও সন্তান আছে। তারা লেখাপড়া করছে। তাদের অধিকারের জন্য আমিও আন্দোলন করি।’ কথাগুলো স্ত্রীকে বলেছিলেন কাঠমিস্ত্রি মো. আরিফুল মিয়া।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে কাঠমিস্ত্রি মো. আরিফুল মিয়া তখন আর নিজেকে ঘরে আটকে রাখতে পারেননি। সকালে নাস্তা না করেই ‘রাস্তা থেকে ঘুরে আসি’ বলে আন্দোলনে যোগ দিতে চলে যান তিনি।
৫ আগস্ট বিকেলে গাজীপুর আনসার একাডেমির ৩ নং গেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হন আরিফুল। পরে ওই দিনই দিবাগত রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর একদিন পর ৬ আগস্ট জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
ভাতের সঙ্গে ডাল আর আলু ভর্তা পছন্দ ছিল শহীদ আরিফুলের। মাছ-মাংসের পরিবর্তে সবজি দিয়ে ভাতই ছিল তার প্রিয় খাবার। শহীদ হওয়ার দিন দুপুরে নিজের হাতে বানানো প্রিয় খাবার আলু ভর্তা ও ডিম দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন তিনি।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর সাথে শহীদ আরিফুলের গ্রামে বাড়িতে কথা হয় তার স্ত্রী হালিজা বেগমের। তিনি বলেন, কাউকে কিছু না বলে, সে নিয়মিত আন্দোলনে যেত। ৪ তারিখ গায়ে ছোট ছোট গুলির দাগ নিয়ে বাসায় আসলে বুঝতে পারি। সেদিন আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করি।
‘৫ তারিখ দুপুরে সে আলু ভর্তা বানালে আমরা একসঙ্গে ডিম আর আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাই। খেতে খেতে সে বলেছিল, আমি আর আলু ভর্তা বানাব না, তোরা বেশি ভাত খাস। সেই খাবারই ছিল তার শেষ খাবার।
পরে ‘হাসিনা পালাইছে’- এমন ফোন পেয়ে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে। তাকে আটকানোর চেষ্টা করলে- ‘আধ ঘন্টা পর ফিরবে’ বলে বের হয়ে যায়। বের হওয়ার সময় গেটে এক ছেলেকে বলেছিল ‘চল রাবি¦, শহীদ হয়ে আসি।’
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার পশ্চিম গোপিনাথপুর গ্রামের মো. খাজা মিয়া (৫৬) ও রশিদা বেগম (৫১) দম্পতির কনিষ্ঠ সন্তান মো. আরিফুল মিয়া। ১৯৯৬ সালের ১ জুন ২ ভাই-বোনের পর নিজ বাড়িতে জন্ম নেন শহীদ আরিফুল। বড় বোন খাতিজা (৩৫)। বিয়ে হয়েছে একই গ্রামে। আর মেজো ভাই মো. রাশিদুল মিয়া (৩১)।
১০ বছর আগে মামাত বোন মোছাম্মৎ হালিজা খাতুনকে ভালোবেসে বিয়ে করেন শহীদ আরিফুল। সুখের সংসারে তাদের একমাত্র সন্তান মো. জিসান মিয়া (৯)। আরিফুল স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে চন্দ্রা পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ২০ হাজার টাকা বেতনে আবুল ফার্নিচারে কাজ করতেন। শহীদ হওয়ার দিনও ৩টি ভ্যানের বডি বানানোর কথা ছিল তার।
শহীদ আরিফুলের স্ত্রী বলেন, বিকেলে স্বামীর কোনো খোঁজ না পেয়ে পৌনে ৪টার দিকে আমার বাবা ওর (আরিফুলের) নম্বরে ফোন দিলে অপরিচিত একজন ফোন ধরে বলে, ফোনটি যার তার মাথায় গুলি লাগছে। সে আর বেঁচে নাই। এরপর সাড়ে ৬টার দিকে একটার পর একটা হাসপাতাল খুঁজে মুখে অক্সিজেন লাগানো অবস্থায় কুমুদিনী মেডিকেলে তাকে পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, ‘রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বারান্দা থেকে রুমের ভিতরে আশেপাশে শুধু লাশ আর লাশ। মেডিকেলে নেওয়ার পর বেডে গিয়ে দেখি, হঠাৎ করেই আমার স্বামীর হাত ধপাস করে পড়ে যায়। এরপর আমি চিল্লান দিয়ে উঠলে সব ডাক্তার জড়ো হয়।’ ‘আমার স্বামী আর ফেরে নি।’ বলতে বলতে কান্না করতে থাকেন হালিজা খাতুন।
তিনি আরও বলেন, ‘সে আমাকে অনেক স্বপ্ন দেখাত। মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে বলত, তোমাকে বাড়ি-ঘর করে দেব, গরুর ঘর করে দেব। এগুলো সামলাতে সামলাতে আমাকে মনেই রাখবা না। বাসার সামনে একটা ৬ তলার ফ্ল্যাট ছিল সেটা দেখে বলত, হালিজা তোমাকে এমন একটা বাড়ি করে দিব। তখন এসব বুঝতে পারি নি। কিন্তু এখন বুঝি, সে যে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, এজন্য এসব বলত।’
শহীদ আরিফুলের মা রশিদা বেগম বলেন, ‘ময়না খুব হাসত। জীবনে একটা চড়া কথা হামার ছইল হামাক কয় নাই। হামার ছইলরা খালি মাইনসের উপকার করে বেড়াত। বাপ নিজ হাতে ঘরের ডেসিন টেবিল, শোকেস বানাইছে। ঘরত সাজানো সব। খালি আরিফ নাই। হামার শোনা চেয়ার বানাইছে। ছোট্ট থেকে হামার ময়না কামাই করে। মারা যাওয়ার তিন দিন আগে কথা হয়, ভাত রান্না করছি কি-না। মা চিন্তা ভাবনা কইরেন না, টাকার ব্যবস্থা হবে। হামার ছইল গ্রামে কারো সাথে কোনদিন ঝগড়া পযন্ত করেনি। দেশ স্বাধীন করতে হামার ময়না চলি গেল।’
শহীদ আরিফুলকে হারিয়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে পরিবারটিতে। আরিফুলের কথা বলে দিনরাত কাঁদে মা-বাবা। আরিফুলের হাতে তৈরি প্রতিটি ফার্নিচার, আলমারি, শোকেস। মায়ের জন্য নিজের হাতে চেয়ার বানিয়ে দিয়েছিলেন। এখনও ঘরে আছে সে সব আসবাবপত্র, কেবল নেই মানুষটি। মা ছেলের হাতের তৈরি এসব জিনিস দেখে দিনরাত আহাজারি করেন।
শহীদ আরিফুল নিয়মিত নামাজ পড়ত। বউকেও নামাজের কথা বলত। নিজে কুরআন ভালো পড়তে না পারায় ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়ানোর কথা বলেছিল। যেন সন্তান বড় হয়ে বাবাকে কুরআন পড়া শেখায়।
স্ত্রী হালিজা ইন্টারস্টোপ গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। তিনি এখন শহীদের রেখে যাওয়া স্বপ্ন বুকে ধারণ করে গ্রামে ফিরে গিয়ে ছেলেকে মানুষ করার চেষ্টা করছেন। ভর্তি করে দিয়েছেন স্থানীয় হেফজ মাদ্রাসায়।
সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ আরিফুলের স্ত্রী জানান, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে তাকে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ৩ লাখ টাকা দিয়েছে। এছাড়া জেলা পরিষদ থেকে ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।