ঢাকা, ২৭ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে সাহসের উজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিল শহীদ আবু সাঈদ। পুলিশের গুলির মুখে দাঁড়িয়ে দুহাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে যেন বলতে চেয়েছিলেন ‘এভাবে মানুষ মারা চলবে না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালে দেয়া সূচনা বক্তব্যে আজ বুধবার এ কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ দেয়া সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বাংলা পঞ্জিকায় দিনটি ছিল আষাঢ়ের শেষ দিন। একদিন পরই শুরু হয় শ্রাবণ। সেদিন সকালে রংপুরের আকাশে ঝরছিল বৃষ্টি। কিন্তু সব উপেক্ষা করে ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে উত্তরের শহর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিশাল প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন বেরোবির শিক্ষার্থীসহ স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যা ছিল তারুণ্যের দ্রোহযাত্রা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নগরীর লালবাগ এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে বিক্ষোভ মিছিল এগিয়ে এলে শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ। তাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এ ছাড়া এই মামলার পাঁচ নম্বর আসামি মো. আরিফুজ্জামান ওরফে জীবনের নেতৃত্বে পাঁচজন পুলিশ সদস্য স্টিল ও কাঠের লাঠি দিয়ে আবু সাঈদের মাথায় আঘাত করেন। এতে তার মাথা থেকে রক্ত বের হয়।
চিফ প্রসিকিউটর তার সূচনা বক্তব্যে বলেন, ওই দিন আষাঢ়ের বাদল কিংবা মেঘ না থাকলেও বৃষ্টি ঝরেছিল।
সে বৃষ্টি গুলির। তাই বৃষ্টিতে পানি না ঝরলেও ঝরেছিল নিরপরাধ ছাত্র-জনতার রক্ত। সেখানেই জুলাই বিপ্লবের সাহসের উজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিল শহীদ আবু সাঈদ।
পুলিশের লাঠিচার্জে রক্তাক্ত হয়েও দুহাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে যেন বলতে চায়েছিলেন, ‘এভাবে মানুষ মারা চলবে না।’ কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের বাঁচাতে চাইলেন যিনি, ঠিক তার বুকেই তাক করা হলো বন্দুকের নল। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা ১৭ মিনিট। ঠিক তখনই গর্জে ওঠে মামলার আট নম্বর আসামি পুলিশের সাবেক এএসআই মো. আমির হোসেনের রাইফেল। যে অস্ত্র কেনা হয়েছিল আবু সাঈদের ট্যাক্সের টাকায়, শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যাবহারের জন্য।
সে অস্ত্রই বিদ্ধ করল আবু সাঈদকে। প্রথম গুলিটি যখন আবু সাঈদের পেটে লাগে, তখন তিনি হতবাক হয়ে যান। আবার বুক প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। তখনই তাকে পরপর দুই রাউন্ড গুলি করেন নয় নম্বর আসামি সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়। এরপর রাস্তার ডিভাইডার পার হয়ে বসে পড়েন আবু সাঈদ। একজন সহযোদ্ধা তাকে মাটি থেকে তোলার জন্য ধরতে গেলে আবার সে পড়ে যান। আবু সাঈদকে নেয়ার সময় তাদের লক্ষ্য করে আবার গুলি চালায় পুলিশ। এতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাওহিদুর হক সিয়ামের শরীরের বাঁ দিকটি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। প্রায় ৬০টি ছররা গুলি তার মাথা, মুখ-হাত, বাহু, পেট, কোমর ও পায়ের বাঁ দিকে বিদ্ধ হয়। আবু সাঈদকে নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্ররা রিকশায় করে রওনা দেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উদ্দেশ্যে। হাসপাতালে নেয়ার পথে সহযোদ্ধাদের বাহুডোরেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে আবু সাইদ।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের কাছে এরকম মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার চান।
এদিকে আজ ট্র্যাইব্যুনালে আবু সাঈদকে গুলি করার দুটি ভিডিও প্রদর্শনের সময় আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন মনিটরের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত হন। এক পর্যায়ে প্রসিকিউটসনের আবেদনে ট্র্যাইব্যুনাল আগামীকাল এই মামলায় প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন।
গত ৩০ জুলাই প্রসিকিউসন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এই মামলায় অভিযোগ গঠনের প্রার্থনা করেন। অন্যদিকে আসামি পক্ষে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চাওয়া হয়। এরপর গত ৬ আগস্ট ট্র্যাইব্যুনাল এই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ২৭ আগস্ট দিন ধার্য করেন।
এই মামলার যে ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনা হয়, তাদের মধ্যে গ্রেফতার ছয়জন আজ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। এরা হলেন- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক সাবেক কর্মচারী মো. আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ।
আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ৩০ জুন ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ। ২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র আবু সাঈদের পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই সোচ্চার হন বহু মানুষ, যাতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। জাজ্জ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।