॥ মো. মামুন ইসলাম ॥
রংপুর, ৯ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : নাকে চোট পেয়ে জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। তবে থেমে যাননি নারী ক্রিকেটার আরিফা জাহান বিথি। দেশের প্রথম ফ্রি নারী ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে তিনি গড়ে তুলছেন ভবিষ্যতের নারী ক্রিকেটারদের।
দেশের জন্য দক্ষ নারী ক্রিকেটার তৈরির লক্ষ্য নিয়ে তিনি সাত বছর আগে রংপুর স্টেডিয়ামে গড়ে তোলেন ‘উইমেন’স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি (ডব্লিউডিসিএ)’।
উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৩২০ তরুণী ইতোমধ্যেই তার একাডেমি থেকে বিনা খরচে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন।
এদের অনেকে সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)-তে, কেউবা খেলছেন দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে।
বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে বিথি বলেন, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেই গড়ে তুলেছেন ডব্লিউডিসিএ। এর খরচ চালাতে নিজের সব সঞ্চয় ঢেলে দিয়েছেন, এমনকি ৫৫ বছর বয়সী মা মাজেদা বেগমের নামে এনজিও থেকে ঋণও নিয়েছেন।
রংপুর শহরের নূরপুরে বেড়ে ওঠা এক অদম্য তরুণী বিথি চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়।
দারিদ্র্যের মধ্যে তার ছোটবেলা কাটলেও, কৈশোর থেকেই ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলার প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ।
তার বাবা মফিজুল ইসলাম (৬০) ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তিনি স্থানীয় একটি পেট্রোল পাম্পে কাজ করতেন। বাবা চাকরি হারালে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়ে।
তখন সংসার চালাতে বিথির মা বাড়ির পাশে একটি মুদি দোকান খোলেন।
মায়ের কষ্ট দেখে বিথি স্কুল শেষে অবসর সময়ে মুদি দোকান চালাতেন।
রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিকের পর পরিবার বিয়ের কথা তুললে বিথি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
বিয়ে করার পরিবর্তে নারীদের ক্রিকেট উন্নয়নের জন্য কিছু করার সংকল্প করেন তিনি।
বিথির ভাষায়, ‘মেয়েরা পিছিয়ে থাকবে কেন? বাল্য-বিয়ে থেকে বেরিয়ে তারা যেন নিজের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে পারে- এই চাওয়া থেকেই কাজ করছি।’
রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ার সালেমা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্রিকেটে আকৃষ্ট হন বিথি। স্কুল পর্যায়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলেছেন তিনি।
পরে ঢাকার পান্তাকুঞ্জ ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হন বিথি। এরপর ২০১১-১২ সালে রংপুর জেলা দলেও খেলেন তিনি।
২০১২ সালে পেশাদার ক্রিকেটে অভিষেক হয় বিথির। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ও প্রথম বিভাগে খেলেছেন তিনি।
ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাব, কলাবাগান ও রায়ের বাজার দলের হয়ে খেলেছেন বিথি।
তবে অনেক দূর যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ২০১৭ সালে নাকে চোট পেয়ে থেমে যায় তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
চিকিৎসকের পরামর্শে খেলা ছাড়লেও ক্রিকেট ছাড়েননি বিথি। ২০১৮ সালে কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুতে বাংলাদেশ হুইলচেয়ার নারী ক্রিকেট দলকে প্রথমবারের মতো প্রশিক্ষণ দেন।
একই বছরে বিথি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি ৬ দিনের প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করেন এবং প্রায় দেড় মাস ঢাকায় ‘আরবান স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্রিকেট দল’কে প্রশিক্ষণ দেন।
পরে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ও দেশের জন্য দক্ষ নারী ক্রিকেটার তৈরির লক্ষ্যে বিথি ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর রংপুর স্টেডিয়ামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘উইমেন’স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি’। প্রথমে শহরের সালেমা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সমাজকল্যাণ বিদ্যাবীথি স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও মরিয়ম নেছা বালিকা বিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩০ জন ছাত্রী নিয়ে শুরু হয় একাডেমির যাত্রা।
সেই শুরুতেই নিজের সঞ্চয়ের সবটুকু ব্যয় করেন বিথি। মা ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়ান।
ওই টাকায় কেনেন ক্রিকেট সামগ্রী আর এভাবেই শুরু হয় দেশের প্রথম ফ্রি নারী ক্রিকেট একাডেমি।
একাডেমির নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলে সপ্তাহে ছয় দিন, বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত।
এখন একাডেমিতে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২০ জনে।
বিথি বলেন, ‘এখন মেয়েরা সব জায়গাতেই এগিয়ে। আমি সব সময় মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করব। আমার স্বপ্ন, আমার একাডেমি থেকে যেন প্রতিভাবান ও সুবিধাবঞ্চিত মেয়েরা ক্রিকেট শিখে সাহসী আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে।’
তিনি আশাবাদী, তার একাডেমি থেকেই একদিন জাতীয় দলের ক্রিকেটার তৈরি হবে, যারা দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।
ক্রিকেট ছাড়ার পর আইন পড়ার ইচ্ছে ছিল বিথির, যাতে মানুষকে সাহায্য করতে পারেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট দিয়েই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এই সাহসী নারী।