যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম

বাসস
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫১

ঢাকা, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র যখন রাতের আকাশ চিরে ইউক্রেনে আঘাত হানে এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো গর্জে ওঠে, তখন ওলগা ক্লিমোভার ঘুম ভাঙে না। কারণ তিনি তখন ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যান—একটি জনাকীর্ণ মানসিক হাসপাতালের বিছানায়।

ইউক্রেনের পোলটাভা থেকে এএফপি জানায়, ৪৪ বছর বয়সী এই নারী বলেন, ‘আমি ওষুধ খেয়ে ঘুমাই, গভীর ঘুম। কিছুই শুনতে পাই না।’ কথা বলার সময় তার দাঁতের ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ে যায়।

তার স্বপ্নে ফিরে আসে নিজের গ্রাম, খেরসনের কিসেলিভকা। ২০২২ সালে এই গ্রামে কয়েক মাস রুশ দখলে ছিলেন তিনি। পরে ইউক্রেনীয় বাহিনী অঞ্চলটি পুনর্দখল করলে ক্লিমোভাকে শত শত কিলোমিটার উত্তরে, কেন্দ্রীয় শহর পোলটাভার এক হাসপাতালে সরিয়ে নেওয়া হয়।

তখন থেকেই তিনি পোলটাভা আঞ্চলিক মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শিজোফ্রেনিয়ায় ভোগা ক্লিমোভা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নিজ গ্রামে থাকা—প্রায় সবাই বৃদ্ধ—আত্মীয়স্বজনের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারেননি।

তিনি বলেন, ‘তারা জানে আমি পোলটাভায় আছি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছি, ওদের দেখতে যাব।’

নতুন রোগীর ঢল

যুদ্ধ শুরুর পর কিয়েভ কর্তৃপক্ষ হাজার হাজার মানসিক রোগীকে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করেছে বলে চিকিৎসকরা জানান।

তবে পূর্ববর্তী রোগীদের পাশাপাশি যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞ সামগ্রিকভাবে সামরিক ও বেসামরিক উভয় জনগণের ভেতর এক বিশাল মানসিক স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, ইউক্রেনের প্রাকযুদ্ধকালীন জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ—৯৬ লাখ মানুষ—মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে  করছে বা এর ঝুঁকিতে রয়েছে।

যুদ্ধ শুরুর আগেই যেটুকু ছিল, তা-ই ছিল সংকুচিত ও তহবিলস্বল্প। এখন সেই সরকারি মানসিক স্বাস্থ্যসেবাও ভেঙে পড়ার উপক্রম।

পোলটাভার প্রধান মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসক ওলেস তেলিউকভ বলছেন, সংকট এতটাই গভীর যে যুদ্ধ শেষ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।

তার নারী ওয়ার্ডে থাকার কথা ৪০ জন, কিন্তু মার্চ মাসে সেখানে ছিলেন ৪৭ জন।

ওষুধের সংকট

মার্চের মাঝামাঝি সময়ে পোলটাভার ওই হাসপাতালে ৭১২ জন রোগীর মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশই যুদ্ধের কারণে অন্য অঞ্চল থেকে আশ্রয় নেওয়া মানুষ। এদের বেশিরভাগই খেরসন, দোনেৎস্ক, লুহানস্ক ও খারকিভ অঞ্চল থেকে এসেছেন।

তাদের মধ্যে রয়েছেন ৪৭ বছর বয়সী ওলগা বেকেতোভাও, যিনি শিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন। রুশ অধিকারে থাকা অবস্থায় খেরসনে তিনি কয়েক সপ্তাহ ওষুধ ছাড়া থাকতে বাধ্য হন। ২০২২ সালের মে মাসে তার খিচুনি হয়, পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়। খেরসন পুনর্দখলের পর তাকে পোলটাভায় পাঠানো হয়।

হাঁটার ছড়িতে ভর দিয়ে তিনি বলেন, ২০২৪ সালে তার স্ট্রোক হয়। তিনি মনে করেন, ‘সারাক্ষণের দুশ্চিন্তাই’ এর কারণ।

মূলত বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ব্যয়বহুল ওষুধের সংকটে চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় কিছু বিদেশি ত্রাণ সংস্থা এগিয়ে এসেছে।

ওষুধ নিয়ে সহায়তা

ফরাসি চিকিৎসক ক্রিস্তিয়াঁ কারের প্রতিষ্ঠিত মানবিক সংগঠন এআইসিএম ইউক্রেনের ক্লিনিক ও মানসিক হাসপাতালে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘অনেক রোগী যুদ্ধের আগেও মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। আবার অনেকে যুদ্ধের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।’

মার্চ মাসে তার সংগঠন পোলটাভার হাসপাতালে খিচুনি ও শিজোফ্রেনিয়ার ওষুধ সরবরাহ করে।

ক্যারার জানান, বর্তমানে ইউক্রেনীয় মনোরোগ চিকিৎসকরা রোগীদের ঘুমের জন্য অপ্রয়োজনীয় ট্রাংকুইলাইজার ব্যবহার করছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা এমন ওষুধ সরবরাহ করেছি, যেগুলো শিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ কমাতে পারে, কিন্তু রোগীকে অবসন্ন করে না।’

রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে ইউক্রেনের স্বাস্থ্যসেবা খাতের আধুনিকায়নের পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৭ সালের সংস্কার মানসিক হাসপাতালে পৌঁছায়নি। এখনো সেখানে সোভিয়েত যুগের অনেক কিছু বজায় রয়েছে।

‘কলঙ্ক সরিয়ে দিতে’

২০২২ সালের রোগী স্থানান্তরের সময়কার বিশৃঙ্খলার কথা স্মরণ করেন ডা. তেলিউকভ বলেন, অনেকেই কোনো কাগজপত্র বা ব্যাগ ছাড়াই এসেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘অনেকে নিজের মানসিক আঘাত নিয়ে পরিবারের সঙ্গে বা চিকিৎসকের সঙ্গে কিছুই বলতে পারেন না। ওরাই সবচেয়ে কঠিন রোগী।’

তেলিউকভ বলছেন, সামরিক বাহিনীর ভেতরেও মানসিক সমস্যার ঢল দেখা যাচ্ছে। তিনি এক নারী সেনার কথা বলেন, যিনি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক রুশ বোমায় প্রাণ হারানো ৫৯ জনের ঘটনা দেখে আতঙ্কে আক্রান্ত হন। আরেক নারী ছিলেন, যিনি ছয় মাস রুশ কারাগারে ছিলেন।

তেলিউকভের ধারণা, তাকে হয়তো যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, তবে পুরোপুরি কিছু বলেননি তিনি।

তেলিউকভের ওয়ার্ডের কক্ষগুলো নাম পেয়েছে রঙ অনুযায়ী, সংখ্যা অনুযায়ী নয়।

তিনি বলেন, ‘এটা কলঙ্কমুক্ত করার জন্য, আমলাতন্ত্র ঝেড়ে ফেলার একটা প্রয়াস!’

‘পিংক’ ওয়ার্ডে ক্লিমোভা এএফপি দলকে বিদায় জানান একঝলক হাসি ও হাত নেড়ে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচার ছাড়া জনগণ নির্বাচন মানবে না : গোলাম পরওয়ার
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় মোশাররফ গ্রেফতার
আন্তঃবাহিনী আযান ও ক্বিরাত প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠিত
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা করা দরকার তা করা হবে : মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসবে পার্বত্য উপদেষ্টা
বাঞ্ছারামপুরে  নির্যাতনের শিকার শিশুটির চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে এলেন তারেক রহমান
আগামী ঈদের আগেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার : জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
জাফরুল্লাহ চৌধুরী তরুণদের কাছে অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবেন : ফারুক-ই-আজম
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে এনফ্রেল প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ
জাফরুর নতুন কমিটি : অডেন সভাপতি ও আকতারুল সাধারণ সম্পাদক
দেশের মানুষ হাসিনার দৃশ্যমান বিচার ও সংস্কার দেখতে চায় : শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি
১০